শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতনের সঙ্গে লেনদেনের খরা দরপতনের যৌক্তিক কারন নেই: মির্জ্জা আজিজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের শেয়ারবাজার টানা দরপতনের বৃত্তে আটকে গেছে। আর কয়েকদি বাদে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদকে সামনে রেখে শেয়ারবাজার চাঙ্গা না হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। এদিকে দরপতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানা উদ্যোগ নিলেও তা কাজে আসছে না। ফলে প্রতিদিন পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীদের হতাশা বাড়ছে। আগের কার্যদিবসের মতো গতকালও দর পতনের মধ্যে দিয়ে শেয়ারবাজারে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। এদিন শেয়ারবাজারের সব সূচক কমেছে। একই সাথে টাকার পরিমাণে লেনদেন আর অধিকাংশ সিকিউরিটিজের দরও কমেছে। এদিন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনে অংশ নেয়া ৯১ শতাংশ কোম্পানির দর কমেছে।
এবিষয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থাহীনতার অভাব। সে কারনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কে পড়েছে। এই আতঙ্কের কারনে শেয়ার বিক্রির মহোৎসবে মেতেছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে শেয়ারবাজারে দর পতনের সঙ্গে লেনদেনের খরা হচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধের কিছু প্রভাব বিশ্বে পড়লেও বাংলাদেশ তেমন প্রভাব পরেনি। এবিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থায় বেশ ভালো শেয়ারবাজারে দরপতনের কোন যৌক্তিক কারন নেই। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের সরাসরি আমাদের দেশের শেয়ারবাজারে পড়ার কথা না। তবে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব রয়ে গেছে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, গুজবের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ না করে, ভালো করে কোম্পানির অতীত-বর্তমান পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
এবিষয়ে বিনিয়োগকারী রাজ্জাক বলেন, সামনে ঈদ এখন যদি বাজার ভালো না হয় ঈদ কিভাবে করবো। রাজ্জাক বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর সম্প্রতি শেয়ারবাজার অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। এতে বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ বাড়িয়েছি। কিন্তু গত কয়েকদিনের দরপতনে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছি। বাজারে প্রতিদিন যে হারে পতন হচ্ছে তাতে আবারও পুঁজি হারানোর শঙ্কার মধ্যে পড়ে গেছে। হঠাৎ কেন এমন পতন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
জামান নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, প্রতিদিনই ভাবি আজ হয়তো শেয়ারের দাম একটু বাড়বে। সকালের দিকে দাম একটু বাড়লেও দিন শেষে দরপতন হচ্ছে। প্রতিদিনই বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছি। আমি যে কয়টি শেয়ার কিনেছি, সবগুলোতে লোকসানে রয়েছি। এই লোকসান কোথায় গিয়ে থামবে কিছুই বুঝতে পারছি না। এভাবে বাজার পড়তে থাকলে সবার মধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলছি, সবাই হতাশার সুরে কথা বলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, সার্বিকভাবে বাজারে এখন এমন দরপতনের বস্তুনিষ্ঠ কোনো কারণ দেখছি না। চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেনের ঘটনা ঘটার পর সোমবার লেনদেনের পরিমাণ আরও কমে গেছে। ফলে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বেড়েই চলেছে। লেনদেন খরার পাশাপাশি এদিন সবকটি মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। লেনদেনে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। এর মধ্যে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের ক্রেতা ছিল না লেনদেনের বেশিরভাগ সময়। গতকাল প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন শুরু হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার মাধ্যমে। ফলে লেনদেনের ১০ মিনিটের মাথায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ২০ পয়েন্টের ওপর পড়ে যায়। আর লেনদেনের সময় ৩০ মিনিট পার না হতেই ধসে রূপ নেয় শেয়ারবাজার।
লেনদেনের প্রথম আধঘণ্টার মধ্যেই অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য হয়ে পড়ে। লেনদেনের শুরুতে এমন পরিস্থিতি দেখা দেওয়ায় একশ্রেণির বিনিয়োগকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায়।
ক্রেতা না পাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম দিনের সর্বনিম্ন দামে বিক্রির আদেশ আসতে থাকে। কিন্তু এ দামেও হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী।
লেনদেনের শেষদিকে এসে ১৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য হয়ে পড়ে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ দিনের সর্বনিম্ন দামে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে চাইলেও তারা ক্রেতা খুঁজে পাননি। দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের ক্রেতা না থাকায় লেনদেনও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩৯০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে ২০২১ সালের ৫ এপ্রিলের পর ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেনের ঘটনা ঘটলো।

এমন ক্রেতা সংকটের বাজারে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে মাত্র ১৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৪৭টির। আর ১৯টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। অর্থাৎ ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হয়েছে।

এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৭২ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৪৮২ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ২৫ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৪০৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ডিএসই শরিয়াহ্ আগের দিনের তুলনায় ১৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৪২৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

বাজারটিতে টাকার অঙ্কে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে জেএমআই হাসপাতালের শেয়ার। কোম্পানিটির ৭৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের ১২ কোটি ২৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ১১ কোটি ২১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে কাট্টালী টেক্সটাইল।

এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, বিকন ফার্মা, ডরিন পাওয়ার, বেক্সিমকো ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্য সূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৭২ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৩৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেওয়া ২৬৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৪টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২২৫টির এবং ১৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্বাচনে অংশ নিতে কাউকে জোর করা সম্ভব নয়: সিইসি
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশকে আরও ২১৫০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক