নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের শেয়ারবাজার আগের তিন কার্যদিবস দর পতন হলেও সোমবার ব্যাপক দরপতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। এই নিয়ে টানা চার কার্যদিবস ধরে শেয়ারবাজারে দরপতন অব্যাহত। গতকাল অধিকাংশ কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের বিক্রির চাপের কারণে ধসে পরে বাজার। এদিন ডিএসইতে ৯১ শতাংশ কোম্পানির দর কমেছে। সূচকের ব্যাপক পতন হলেও বিক্রির চাপে টাকার পরিমাণে লেনদেন আগের কার্যদিবস থেকে বেড়েছে। ব্যাপক পতনের কারণে এদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স সাড়ে ৯ মাস আগের অবস্থানে নেমে গেছে। ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে দুই শতাংশের ওপরে। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৩৪.৫৩ পয়েন্ট বা ২.০৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪৩০.৯৩ পয়েন্টে। ডিএসইর এই সূচক কমে ৯ মাস ১৪ দিন বা ১৯২ কার্যদিবস আগের অবস্থানে নেমেছে। এর আগে ২০২১ সালের ২৯ জুলাই সূচকটি গতকালের চেয়ে কম অর্থাৎ ৬ হাজার ৪২৫.২৫ পয়েন্টে অবস্থান করছিল।
এবিষয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থাহীনতার অভাব। সে কারনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কে পড়েছে। এই আতঙ্কের কারনে শেয়ার বিক্রির মহোৎসবে মেতেছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে শেয়ারবাজারে বড় দর দরপতন হচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, ডলার সংকট, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি দেউলিয়া ঘোষণার পাশাপাশি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ধরা পড়ায় পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সঙ্গে পুঁজিবাজারে জড়িতরা ভয়-আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাতে বাজারে প্যানিক সেল বেড়েছে। আর এই ইস্যুগুলোকে কাজে লাগিয়ে কারসাজি চক্র কম দামে শেয়ার কিনছে। আর বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।
পাশাপাশি রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধের কিছু প্রভাব রয়েছে। এবিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল রাজ্জাক বলেন, শেয়ারবাজারের দর পতনের পেছনে যৌক্তিক কারন দেখছিনা। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ কোম্পানি আইসিবি শেয়ার নাকিনে তারা শেয়ার বিক্রয় করে দিচ্ছে। তার পাশাপাশি কেউ কেউ গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। রাজ্জাক আরও বলেন, গত কয়েকদিনের দরপতনে বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে বিনিয়োগকারীরা। বাজারে প্রতিদিন যে হারে পতন হচ্ছে তাতে আবারও পুঁজি হারানোর শঙ্কার মধ্যে পড়ে গেছে। জামান নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, প্রতিদিনই ভাবি আজ হয়তো শেয়ারের দাম একটু বাড়বে।
সকালের দিকে দাম একটু বাড়লেও দিন শেষে দরপতন হচ্ছে। প্রতিদিনই বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছি। আমি যে কয়টি শেয়ার কিনেছি, সবগুলোতে লোকসানে রয়েছি। এই লোকসান কোথায় গিয়ে থামবে কিছুই বুঝতে পারছি না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, সার্বিকভাবে বাজারে এখন এমন দরপতনের বস্তুনিষ্ঠ কোনো কারণ দেখছি না। তবে বড় ধরনের দরপতনের কারনে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। তবে গতকাল বড় দরপতনের মধ্যেই ছয় প্রতিষ্ঠানের ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। এ ছয় প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বেড়ে দিনের সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করে। এরপরও লেনদেনের বেশিরভাগ সময় প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের বিক্রিতা ছিল না। এ ছয় কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- এফএএস ফাইন্যান্স, এস আলোম কোল্ড রোল্ড স্টিল, এনআরবিসি ব্যাংক, ফু-ওয়াং সিরামিক, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং শাহিনপুকুর সিরামক। বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, এদিন ডিএসইতে লেনদেন শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমতে থাকে। দিনের শুরুতে দেখা দেওয়া পতনের ধারা অব্যাহত থাকে লেনদেনের শেষপর্যন্ত। এমনকি লেনদেনের সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে পতনের মাত্র। এতে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১৩৪ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৪৩০ পয়েন্টে নেমে গেছে। এর মাধ্যমে টানা চার কার্যদিবস পতনের মধ্যে থাকলো শেয়ারবাজার। এমন টানা পতনের কারণে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকটি গত বছরের ২৯ জুলায়ের পর সর্বনিম্ন অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ৪০ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৩৬৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ আগের দিনের তুলনায় ২১ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৪১০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসইতে ৩৮১টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টির বা ৬.৮৩ শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে। দর কমেছে ৩৪৮টির বা ৯১.৩৩ শতাংশের এবং ৭টির বা ১.৮৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর অপরিবর্তিত রয়েছে। ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ২৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ৮২৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন বেড়েছে ২০০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ডিএসইতে টাকার অংকে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে শাহিনপুকুর সিরামিকের শেয়ার। কোম্পানিটির ৬০ কোটি ৩৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বেক্সিমকোর ৪৯ কোটি ১৯ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ৪৩ কোটি ৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং। এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- আরডি ফুস, ফু-ওয়াং সিরামিক, এনআরবিসি ব্যাংক, ওরিয়ন ফার্মা, স্যালভো কেমিক্যাল, এসিআই ফরমুলেশন এবং লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ৩৮২ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৪৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা। লেনদেন অংশ নেওয়া ৩০৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৩টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৬৬টির এবং ৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।