নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের শেয়ারবাজার টানা দরপতনের অস্থিরতা রোধে মার্জিন ঋণের সুবিধা বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা জারি এবং শেয়ারবাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে অর্থমন্ত্রীর বিভিন্ন দিক নির্দেশনার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক কাটছে। টানা আট কার্যদিবস পর সোমবার ব্যাপক সূচকের উত্থানে মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে।
এবিষয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেন, অর্থমন্ত্রীর বিভিন্ন দিক নির্দেশনার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক কাটতে শুরু করেছে। তারা বলেন, সামনে বাজার আরো চাঙ্গা হবে। সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সেচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুঁজিবাজারের দরপতন ঠেকাতে মার্জিন ঋণ সুবিধা ১:১ টাকায় বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইসিবির মাধ্যমে ব্যাংকের বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে এই প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এই উদ্যোগের ফলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেয়ারবাজার। এর আগে রোববার আট কর্মদিবসে শেয়ারবাজারে সূচক পড়ে যায় ৫৫৫ পয়েন্ট। বাজারের এমন অবস্থায় জরুরীভাবে অর্থমন্ত্রী বসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআরর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে। এই বৈঠকে মন্ত্রী শেয়ারবাজার নিয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দেন যা বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। আর যেহেতু এই বাজারে আস্থার সংকটটাই প্রধান সমস্যা, সেখানে দরপতন ঠেকাতে সরকারের এই ভূমিকা বিনিয়োগকারীদের মনের শঙ্কা দূর করেছে অনেকটাই।
বৈঠকে অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার করে বলেন, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারের খারাপ অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। যে করেই হোক বাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এ জন্য বৈঠকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার নির্দেশ দেন মন্ত্রী। পুঁজিবাজার টেনে তুলতে এবার রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির মাধ্যমে ব্যাংকের বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে এই প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আইসিবিকে দেয়া দেড় শ কোটি টাকার যে তহবিলের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটির মেয়াদ বাড়িয়ে তহবিলের আকার দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্তও হয়েছে। সোমবারই এই তহবিল থেকে বিনিয়োগ করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে বেশ কিছু মতপার্থক্যের ইস্যু ধরেই গত সেপ্টেম্বর থেকে সংশোধন শুরু হয়। পরে যোগ হয় ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি ও খাদ্যমূল্যের দর বৃদ্ধি, মুদ্রার দরপতন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ধসসহ নানা বৈশ্বিক ইস্যু। এই পরিস্থিতিতে বৈঠকে পুঁজিবাজারে সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিকে বাজারে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে ব্যাংকগুলো আইসিবির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে যে বিনিয়োগ করবে, সেটাকে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমার (এক্সপোজার লিমিট) বাইরে রাখা হবে।
বর্তমানে কোনো শেয়ারের ক্রয়মূল্য অথবা বাজারদর যেটি বেশি, সেটি এক্সপোজার লিমিট হিসেবে গণ্য হয়। তবে বিএসইসি চাইছে এটি শেয়ারের ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ হোক। আবার কোনো ব্যাংক নিজে যে বিনিয়োগ করে, সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য যে টাকা দেয়, আইসিবিকে যে ঋণ দেয়, সবই এক্সপোজার লিমিটের ভেতরে পড়ে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আইসিবিকে দেয়া ১৫৩ কোটি টাকার যে তহবিলের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটির মেয়াদ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তহবিলের আকারও বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। গতকাল টানা আট কর্মদিবস পর শেয়ারবাজারে থেমেছে শেয়ার বিক্রির চাপ। শেয়ার বিক্রির চাপ কমে যাওয়ায় গতকাল ব্যাংক, বীমা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব খাতের শেয়ারের দাম বাড়ায় এদিন দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচক বেড়েছে ১১৮ পয়েন্ট। অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক বেড়েছে ৩২২ পয়েন্ট। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন শুরু হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে। ফলে শেয়ারবাজার খুলতেই ডিএসইর প্রধান সূচক প্রায় ৫০ পয়েন্ট বেড়ে যায়। আর লেনদেনের দুই মিনিটের মাথায় সূচকটি একশো পয়েন্ট বেড়ে যায় এবং লেনদেনের ১০ মিনিটের মাথায় বাড়ে ১৩৪ পয়েন্ট। লেনদেনের একপর্যায়ে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকটি ১৪৪ পয়েন্ট বেড়ে যায়। তবে লেনদেনের শেষদিকে এসে সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কিছুটা কমে। এতে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১১৮ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার ২৬১ পয়েন্টে উঠে এসেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ৩২ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ৩০৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ আগের দিনের তুলনায় ১৫ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৩৭৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ৯০ শতংশ বা ৩৪৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৯টির। আর ১৪টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৬৫৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ৬৮২ কোটি ২১ লাখ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কমেছে ২৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ডিএসইতে টাকার অংকে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার। কোম্পানিটির ৪৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা শাহিনপুকুর সিরামিকের ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ২৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং। এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, আইপিডিসি ফাইন্যান্স, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, এসিআই ফরমুলেশন, ফরচুন সুজ, ওরিয়ন ফার্মা এবং আরডি ফুড। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই বেড়েছে ৩২২ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ২৪ কোটি টাকা। লেনদেন অংশ নেওয়া ২৭৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০৭টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৫১টির এবং ১৬টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।