নিজস্ব প্রতিবেদক : অতীতে হজযাত্রীদের নিয়ে দালাল-প্রতারকদের প্রতারণা, হজযাত্রী পরিবহনে চরম বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম সাধারণ ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে এখন হজযাত্রীদের হয়রানি লাঘব হয়েছে।
শুক্রবার (৩ জুন) হজ কার্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়ে এ কথা জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে রাজধানীর আশকোনা হজক্যাম্পের সঙ্গে ধর্ম মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৯ সালে আমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা হজ ব্যবস্থাপনা বিশ্বমানে উন্নতি করার লক্ষ্যে শুরু করি ‘ই-হজ’ ব্যবস্থাপনা। হজযাত্রীর প্রাক-নিবন্ধন, নিবন্ধন, ই-হলথ প্রোফাইল তৈরি, ই-টিকিট, হজযাত্রী পরিবহন, মক্কা-মদিনায় আবাসন ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা প্রদানসহ সব ক্ষেত্রে সুন্দর ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করি। পুরো হজক্যাম্প-কে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
‘আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে হজযাত্রীদের হয়রানি লাঘব হয়েছে, সুযোগ-সুবিধাদি বৃদ্ধিসহ হজ পালন যেমন সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির আওতায় এসেছে, তেমনি প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, এখন অনলাইন সুবিধা ব্যবহার করে হজযাত্রীরা হজের প্রাক-নিবন্ধন ও নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছেন। প্রাক-নিবন্ধন প্রক্রিয়া সারা বছর চলমান আছে। আমরা ২০০৯ সালে জেদ্দায় পৃথক হজ অফিস স্থাপন করি, সেখানে একজন কাউন্সেলর ও একজন কনসাল জেনারেল নিয়োগ দিই। আমাদের এ সিদ্ধান্তের ফলে গত ১৩ বছরে হজ ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের সেবা প্রদান অনেক সহজতর ও উন্নততর হয়েছে।
হজযাত্রীদের সুবিধার্থে ২০১০ সালে জেদ্দা হজ টার্মিনালে প্লাজা ভাড়া নেওয়ার কথা জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে আমরা বিমানের হজ পূর্ববর্তী খালি ফ্লাইটে জমজমের পানি ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করেছি। বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে অতীতের অনিয়মকে দূর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছে।
‘আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির মাধ্যমে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিকটবর্তী স্থানে সাশ্রয়ী এবং উন্নত বাড়ি/হোটেল ভাড়া করা হচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রীরা যাতে কোন হয়রানির শিকার না হন সেজন্য মক্কা ও মদিনা শরীফে সরকারি ও হাব নেতাদের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক তদারকির ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৯ সালের হজ ব্যবস্থাপনা অধিকতর ডিজিটালাইজড ও উন্নততর করেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এর ফলে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ও সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে হজযাত্রীরা সহজেই তাদের যাবতীয় তথ্য ও সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। সরাসরি বিমান টিকিট বিক্রয়ের ব্যবস্থা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও মেনিনজাইটিস টিকা প্রদান, হজক্যাম্পে পিসিআর টেস্টের সেম্পল সংগ্রহের ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মক্কা, মদিনা ও জেদ্দায় ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। সার্বিক হজ ব্যবস্থাপনার যাবতীয় কার্যাবলী অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। আগামী বছরগুলোতেও হজ ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত হয় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
সরকারের সক্ষমতা ও উন্নত ব্যবস্থাপনার কারণে হজযাত্রী সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৬ সালে হজ যাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৭ হাজার ৯৮৩ জন। ২০১৯ সালে হজযাত্রীর সংখ্যা হয় ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। ২০২০ সালে আমাদের জন্য হজযাত্রীর কোটা ছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার ১৯৮ জন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হজযাত্রী বৃদ্ধির হার ১১৬ শতাংশ, যা আমাদের সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন ও সক্ষমতার পরিচয় বহন করে।
শেখ হসিনা বলেন, ২০১৯ সালের হজে সৌদি আরবের রুট টু মক্কা ইনিশিয়েটিভ এর আওতায় প্রায় ৬০ হাজার হজযাত্রীর ইমিগ্রেশন ঢাকায় সম্পন্ন হয়েছে যা মোট হজযাত্রীর ৪৬ শতাংশ। এর ফলে হজযাত্রীদের হজযাত্রাজনিত কষ্ট বহুলাংশে লাঘব হয়। ২০১৯ সালের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা থেকে শতভাগ হজযাত্রীর ‘রুট টু মক্কা ইনেসিয়েটিভ’ এর আওতায় সৌদি পর্বের ইমিগ্রেশন ঢাকায় সম্পন্ন করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে; যা হজ ব্যবস্থাপনায় একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
‘হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা আইন-২০২১’ প্রণয়নের ফলে হজ কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও অসদাচরেণের অভিযোগের প্রতিকার সহজ হচ্ছে বলেও জাননান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, হজযাত্রীদের সাথে কোন এজেন্সি প্রতারণা বা হয়রানি করলে সে এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল, জামানত বাজেয়াপ্ত ও আর্থিক জরিমানাসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতেও আল্লাহর ঘরের মেহমানদের যারা হয়রানি বা প্রতারণা করবে তাদের কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে বাংলাদেশে ইসলামের নামে মানুষ হত্যা, খুন, বোমাবাজি ছিল নিত্য-নৈমত্তিক বিষয়। ধর্মের নামে মানুষ খুন থেকে দেশকে উদ্ধার করতে আমরা জঙ্গিবাদ বিরোধী কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। দেশকে জঙ্গিবাদের হাত থেকে মুক্ত করে পবিত্র ইসলামের শান্তিময় মহিমাকে জাগ্রত রাখার জন্য আলেম ওলামাদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কুরআনের শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমরা মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় লাখ লাখ শিশুকে কুরআন শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সাথে সাথে ৬৪৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্প পুনরায় চালু করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে এ প্রকল্পের বরাদ্দ ২ হাজার ২৭২ কোটি ৪ লক্ষ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
‘আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয় একটি করে মোট ৫৬৪ টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। যার মধ্যে ৫০টি মসজিদ ইতোমধ্যে উদ্বোধন করা হয়েছে। এ বছর আরও ১০০টি মসজিদ উদ্বোধন করা হবে।’
তিনি বলেন, অন্যান্য সব ধর্মের জন্যও আমাদের সরকার নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দেশে সব ধর্মের মানুষ সুন্দর সহাবস্থানে থেকে যার যার ধর্ম চর্চা করছে। আজ সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
‘কিন্তু সম্প্রতি ধর্মকে অপব্যবহার করে এক শ্রেণির ইসলামের লেবাসধারী ব্যক্তিবর্গ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছে। তারা ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ কখনও তাদের প্রশ্রয় দেবে না।’
এ সময় তিনি পবিত্র হজ কার্যক্রম-২০২২’ (১৪৪৩ হিজরি)- এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।