নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের শেয়ারবাজার দরপতনের বৃত্তে আটকে পড়েছে নি:স্ব হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। গতকাল সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবস মঙ্গলবারও ব্যাপক দরপতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইতে এক বছর সাড়ে তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে। ডিএসইতে টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৩১৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকার। এর আগে ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল ২৩৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল।
এবিষয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেন, শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থাহীনতার অভাব। সে কারনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কে পড়েছে। এই আতঙ্কের কারনে শেয়ার বিক্রির মহোৎসবে মেতেছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে শেয়ারবাজারে দর পতনের সঙ্গে লেনদেনের খরা হচ্ছে। ঈদের ছুটির পর থেকেই পতনের মধ্যে ছিল দেশের শেয়ারবাজার। এর মধ্যে আবার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানায় সরকার। ফলে দরপতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এতে করে পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা।
এবিষয়ে জামান নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ঈদের পর টানা দরপতন হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নি:শ্ব হচ্ছে। নতুন গর্ভনর আশার পর ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিল কিন্তু এখনো কাগজে কলমে বাস্তবায়ন না হওয়া বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছে না। জামান আরও বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সংকটে আছে তারল্যর সংকট নেই। আমি যে কয়টি শেয়ার কিনেছি, সবগুলোতে লোকসানে রয়েছি। এই লোকসান কোথায় গিয়ে থামবে কিছুই বুঝতে পারছি না। এভাবে বাজার পড়তে থাকলে সবার মধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে।
শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাজার নিয়ে গুজব তৈরি হচ্ছে সে কারনে দরপত হচ্ছে। এখন এমন কোনো কারণ দেখছি না যে শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটবে। তিনি বলেন, অনেক দিন হয়ে গেলো বাজার নিম্নমুখী। বাজার ভালো করতে বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকে পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজ্জাক আরও বলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থাও খরাপনা আশা করি বাজার তারাতারি ঘুরে দাঁড়াবে। ডিএসই’র একজন সদস্য বলেন, শেয়ারবাজারে এখন যে হারে দরপতন হচ্ছে, তার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। তবে কিছু বিনিয়োগকারী মূল মার্কেটে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়ে এসএমই মার্কেটে বিনিয়োগ করছে। এ কারণে মূল বাজারে লেনদেন কিছুটা কম হচ্ছে। এছাড়া কিছু প্রতিষ্ঠানের দরপতনের চিত্র দেখে মনে হচ্ছে, কোনো গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে দরপতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
এবিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থাহীনতার অভাব। সে কারনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কে পড়েছে। পাশাপাশি দেশের সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিথি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চিন্তা ভাবনা আছে। সে কারনে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে। এমনিতে অর্থনৈতিক চাপের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা ধরনের গুজব তৈরি হচ্ছে সে কারনে দরপত হচ্ছে। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, সরকার বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং দিয়েছে। এতে শিল্পের উৎপাদন কিছুটা হলেও হবে বাধাগ্রস্ত। রপ্তানি আয় কমতে পারে। এ কারণে শেয়ারবাজারের বিরিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ফলে বিক্রির চাপ বেড়েছে এবং দরপতন দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমি বলবো যে খুব বেশি মাত্রায় শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়া উচিত নয়। সেই সঙ্গে বিক্রির চাপ না বাড়িয়ে শেয়ার ধরে রাখা উচিত। কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখা উচিত পরিস্থিতি কি দাঁড়ায়। এদিকে মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হবে। প্রথমে এক সপ্তাহ পরীক্ষামূলকভাবে চলবে এটি। এরপর দরকার হলে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া হতে পারে।
সোমবার লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেওয়ার পরই শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়। এদিন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৮৭ পয়েন্ট কমে যায়। ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য হয়ে পড়ে ২৭৫ প্রতিষ্ঠানের।
এ পরিস্থিতিতে গতকাল শেয়ারবাজার খুলতেই বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ দিনের সর্বনিম্ন দামে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট বিক্রির আদেশ দিতে থাকেন। ফলে সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য হয়ে পড়ে। লেনদেনের শেষপর্যন্ত অব্যাহত থাকে ক্রেতা সংকট।
ফলে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে মাত্র ২১টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৪৪টির। আর ১৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। দাম কমার তালিকায় স্থান করে নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪৩টির শেয়ার ও ইউনিটের দাম দিনের সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে। এরপর লেনদেনের বেশিরভাগ সময় এসব প্রতিষ্ঠানের ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য পড়ে থাকে। এতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৬৩ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ১৫৩ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ২২ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ২১৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ আগের দিনের তুলনায় ১১ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩৪৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
এর মাধ্যমে ঈদের পর লেনদেন হওয়া ছয় কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে দরপতন হলো। ঈদের আগে শেষ পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তিন কার্যদিবসই পতন দিয়ে পার হয়। ফলে শেষ ১১ কার্যদিবসের মধ্যে নয় কার্যদিবসই পতনের মধ্যে থাকলো শেয়ারবাজার।
মূল্যসূচক কমার পাশাপাশি বাজারটিতে লেনদেনের পরিমাণও কমেছে। দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩১৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ৫১৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কমেছে ১৯৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে ২০২১ সালের ৫ এপ্রিলের পর ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেনের ঘটনা ঘটলো। গত বছরের ৫ এপ্রিল বাজারটিতে ২৩৬ কোটি ৬০ লাখ টাকার লেনদেন হয়। এরপর ডিএসইতে আর এত কম লেনদেন হয়নি।
লেনদেন খরার বাজারে ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ার। কোম্পানিটির ১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা কেডিএস’র লেনদেন হয়েছে ১০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ৮ কোটি ২৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে গ্রামীণফোন, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, এইচ আর টেক্সটাইল, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোনালী পেপার, স্কয়ার ফার্মা এবং ওরিয়ন ইনফিউশন।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ২১৪ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ১১ কোটি ৭০ টাকা। লেনদেন অংশ নেওয়া ২৮৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৯টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৪৬টির এবং ২১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।