নিউজ ডেস্ক : চলমান বৈশ্বিক সংকটেও প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, করোনার ভয়াবহ সংকট ও তার পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা যেন দেশের অদম্য সাহসী অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে না পারে।
বৈশ্বিক সংকটে প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদন কোনোভাবেই ব্যাহত করা যাবে না। উৎপাদনে কোথাও যাতে গাফিলতি না হয় সেটা মনে রাখতে হবে।
বুধবার (২ নভেম্বর) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ মিলনায়তনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্পের আওতায় প্রডিউসার গ্রুপ সক্রিয়করণ ও প্রাণিসম্পদ কৃষক মাঠ স্কুল পরিচালনা বিষয়ক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদার সভাপতিত্বে কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ। সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র অ্যাগ্রিকালচার ইকনোমিস্ট ও এলডিডিপি প্রকল্পের টাস্ক টিম লিডার আমাদো বা। স্বাগত বক্তব্য দেন এলডিডিপি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুর রহিম। এলডিডিপি প্রকল্প নিয়ে উপস্থাপন করেন প্রকল্পের প্রধান কারিগরি সমন্বয়ক ড. মো. গোলাম রব্বানী।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের সব ধরনের যোগান থাকা সত্ত্বেও যাতে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয় সেটা মনে রাখতে হবে। প্রাণিসম্পদ খাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ধরে রেখে এ খাতকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি গুণগত মানেও এ খাতকে উন্নত করতে হবে। এ খাতের টেকসই উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় খাত প্রাণিসম্পদ। এ খাত থেকে দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনের সঙ্গে এলডিডিপি প্রকল্প সম্পৃক্ত। দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনে সমৃদ্ধ হতে না পারলে খাবারের বড় একটি অংশের সংকট হতে পারতো। আমিষের সংকটে আমরা বিপন্ন হয়ে পড়তাম। প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদন বাড়ার কারণে প্রান্তিক মানুষদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ছে। তারা উদ্যোক্তা হয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। নারী, বিধবা, দরিদ্র, অসহায়, বেকার সবাই মিলে সংযুক্ত হয়ে এলডিডিপি প্রকল্পের প্রডিউসার গ্রুপ তৈরি হয়েছে। ফলে আর্থিকভাবে গ্রামীণ জীবনের আমূল পরিবর্তন আসছে।
মন্ত্রী বলেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রাণিসম্পদ খাতে বড় সাফল্য এসেছে। তারাই প্রাণিসম্পদ খাতে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও সাফল্যের চাবিকাঠি। প্রকল্পের অর্থ যেন অপব্যবহার না হয় সে বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রাণিসম্পদ খাতকে আরও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এ খাতে সম্পৃক্তদের সার্বক্ষণিকভাবে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, আজ বাংলাদেশ মাংস ও ডিমে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুধেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি। এ অর্জন করতে না পারলে কোরবানির সময় ভারত-মিয়ানমার থেকে গবাদিপশু না আসা পর্যন্ত কোরবানির চাহিদা পূরণ করা যেত না। আজ আমরা প্রাণিসম্পদ খাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন বিশ্বকে দেখাতে পারি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ খাতের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে সব সময় উৎসাহিত করেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে মাংসের চাহিদা আমাদের দেশে আসছে। এ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জীবনামুক্ত মাংস সরবরাহের জন্য রোগমুক্ত প্রাণিসম্পদ অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। দেশে আন্তর্জাতিক মানের মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার তৈরি করা হয়েছে। যাতে মাংস রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনোরকম ক্ষতিকর অবস্থার মুখোমুখি আমরা না হই।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব বলেন, প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প প্রাণিসম্পদ খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন করবে। এ খাতের ইতিবাচক রূপান্তরের জন্যই এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) এর আওতায় দেশব্যাপী প্রান্তিক খামারিদের নিয়ে বিভিন্ন ভ্যালুচেইন ভিত্তিক ৫৫০০টি প্রোডিউসার গ্রুপ (পিজি) গঠন করেছে। প্রোডিউসার গ্রুপ বা পিজিই হচ্ছে এলডিডিপির প্রাণ। প্রতিটি পিজিতে রয়েছেন ২০ থেকে ৪০ জন খামারি। এসব পিজির মাধ্যমে প্রকল্পটি খামারিদের কাছে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ইত্যাদি পৌঁছে দেবে এবং তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন করবে। প্রতিটি পিজির জন্য আলাদা আলাদা প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে এবং অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সরবরাহ করা হয়েছে সাইন বোর্ড, আইডি কার্ড, রেজিস্ট্রেশন বুক, কার্যবিবরণী রেজিস্ট্রার, গঠনতন্ত্র, হিসাব বই, সঞ্চয় বই ইত্যাদি। সমবায় অধিদপ্তরের অধীনে আগামীতে প্রতিটি পিজির রেজিস্ট্রেশন করা হবে।
এসব পিজিভিত্তিক একটি করে লাইভস্টক ফার্মারস ফিল্ড স্কুল (এলএফএফএস) পরিচালিত হবে। এলএফএফএসগুলোতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শিগগিরই শুরু হবে। এ লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ ও এলডিডিপির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে মাস্টার ট্রেইনার। আধুনিক খামার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহযোগিতা দেওয়ার পাশাপাশি পিজির মাধ্যমে ওষুধ, টিকা, দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, উন্নত জাতের ঘাসের কাটিং ইত্যাদি দেওয়া হবে।
এছাড়া খামারিদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ম্যাচিং গ্রান্ট দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ (যেমন- খাদ্য, পুষ্টি, রোগ ইত্যাদি) শক্তিশালী করার পাশাপাশি ফরোয়ার্ড লিংকেজ (যেমন- বাজার সংযোগ সৃষ্টি, ভ্যালু এডিশন ইত্যাদি) বাড়াতেও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হবে। বিশেষ করে দুধের ক্ষেত্রে ৪০০টি ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার ও ২০টি মিল্ক হাব স্থাপনের মাধ্যমে খামারিদের সহজে ও ন্যায্যমূল্যে দুধ বিক্রয়ে সহায়তা দেওয়া হবে। উৎপাদিত মাংস বিক্রয়ে সহযোগিতার অংশ হিসেবে স্লটার হাউস ও স্লটার স্লাব নির্মাণ করা হচ্ছে। এসবের ফলে খামারিদের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দেশের ৬১ জেলার ৪৬৬ উপজেলায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
কর্মশালায় মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও প্রকল্পগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা; সব বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং লাইভস্টক এক্সটেনশন অফিসার, মনিটরিং অফিসার, অন্যান্য স্টেকহোল্ডার ও গণমাধ্যমকর্মীসহ প্রায় ১২০০ জন অংশগ্রহণ করেন।