হাতিরঝিলের সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা

নিউজ ডেস্ক : হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পে সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদসহ চার দফা নির্দেশনা ও নয় দফা সুপারিশ করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেছেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকের দায়ের করা এ সংক্রান্ত লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। আজ সোমবার প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন।

আদালতে রাজউকের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ব্যারিস্টার ইমাম হাসান। রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। গত ১৯ জুন হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পে সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদসহ চার দফা নির্দেশনা ও নয় দফা সুপারিশ সম্বলিত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠানো হয়। গত ২৪ মে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পে সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদসহ চার দফা নির্দেশনা ও নয় দফা সুপারিশ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল এবং বিচারপতি রাজিক আল জলিলের স্বাক্ষরে মঙ্গলবার (২৪ মে) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৫৫ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়। পরে এই রায় স্থগিত চেয়ে লিভ টু আপিল করে রাজউক।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, রাজধানীর হাতিরঝিলের পানি এবং এর নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদকে কোনোরূপ ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না। প্রতিটি ফোঁটা পানি অতি মূল্যবান। পানির চেয়ে তথা সুপেয় পানির চেয়ে মূল্যবান আর কোনো সম্পদ এ পৃথিবীতে নেই। সুতরাং প্রতিটি ফোঁটা পানির দূষণ প্রতিরোধ করা একান্ত আবশ্যক। রায়ে আদালত আরও বলেছেন, There is no ‘planet B’ (দ্বিতীয় কোনো পৃথিবী নেই)। এ পৃথিবী ব্যতীত আর কোনো গ্রহে পানির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে এক ফোঁটা পানি এ পৃথিবীর বাইরে থেকে আনতে সক্ষম হয়নি। অথচ উক্ত খরচের শত ভাগের এক ভাগ টাকা খরচ করলে আমরা আমাদের গ্রহের পানিকে দূষণমুক্ত ব্যবহারযোগ্য রাখতে সক্ষম। হাতিরঝিলের পানি এবং এর নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদকে কোনোরূপ ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না।

রায়ে রিট মামলাটি একটি চলমান আদেশ হিসেবে অব্যাহত থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া যেসব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া হাতিরঝিল ও পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক প্রচারণা ও সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছে রায়ে তাদের অভিনন্দন জানানো হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে হাতিরঝিল সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, হাতিরঝিলসহ তেজগাঁও এলাকায় অনেক ভূ-সম্পত্তি ভাওয়াল রাজার এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজার হাতিরপাল এই ঝিলে স্নান করত এবং জলে বিচরণ করত বলে কালের পরিক্রমায় এর নাম হয় ‘হাতিরঝিল’।

বেগুনবাড়ি খালসহ হাতিরঝিল প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। ১ হাজার ৯৭১.৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৩০২ একর জমির উপর এ প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠিত। প্রকল্প এলাকার মোট ১৬ কি.মি. রাস্তায় কোনো বাস অথবা মিনিবাস চলাচলের অনুমতি ছিল না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৫/২০০৯তম সভায় অনুমোদিত লে-আউটে প্রস্তাবিত ওয়াকওয়ে ও রোডওয়ে এলাইনমেন্ট ব্যতীত অন্য কিছু ছিল না।

প্রকল্পটি ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন, বৃষ্টি, বন্যাজনিত পানি ধারণ, বৃষ্টির পানি পয়ঃনিষ্কাশন ও নগরের নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। খালগুলোর জন্য প্রস্তাবিত সুবিশাল লেকটি একটি নিয়ন্ত্রিত ‘হাইড্রোলিক সিস্টেম’ হিসাবে কার্যকর হয়। এতে ওই এলাকার ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পায়, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত পাবলিক স্পেসের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। রমনার পাশাপাশি একটি সুবিশাল নীল জলাধারবেষ্টিত উন্মুক্ত স্থানের অভাব লাঘব হয়। যা বিশ্বের কাছে ঢাকা মহানগরীর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট আরও বলেছেন, যেহেতু পৃথিবীর উপরিভাগের ৭১ শতাংশ পানি দ্বারা আবৃত থাকলেও তার মাত্র ৩ শতাংশ ফ্রেশ ওয়াটার তথ্য ব্যবহারযোগ্য পানি; যেহেতু পৃথিবীর ৮৭ শতাংশ পানি সমুদ্রের যা লবণাক্ততার কারণে যেমনি পানযোগ্য নয় তেমনি ফসল উৎপাদনেও ব্যবহারযোগ্য নয়। যেহেতু পৃথিবীর ৩ শতাংশ ফ্রেশ ওয়াটার তথ্য ব্যবহারযোগ্য পানির মধ্য থেকে ২.৫ শতাংশ পানি মাটি, বায়ুমণ্ডল, গ্লাসিয়ার (Glaciers) এবং পোলার আইস ক্যাপ (polar ice caps) এ আবদ্ধ থাকার কারণে, চরম দূষিত থাকার কারণে এবং মাটির অনেক গভীরে কারণে ব্যবহার করা সম্ভব নয়; যেহেতু পৃথিবী ৩ শতাংশ ফ্রেশ ওয়াটার তথ্য ব্যবহারযোগ্য পানির মধ্য থেকে মাত্র ০.৫ শতাংশ সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জীবনধারণ ও ব্যবহারের জন্য, সমগ্র পৃথিবীর প্রাণীকূলের বেঁচে থাকার জন্য মজুত আছে। যেহেতু পৃথিবীর জনসংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাক না কেন এবং প্রাণীকূল ও ফসলাদির উৎপাদন যতই বাড়ানো হোক না কেন ফ্রেশ ওয়াটার তথ্য ব্যবহারযোগ্য পানি ওই ০.৫ শতাংশ নির্ধারিত এবং যেহেতু ০.৫ শতাংশ এর ওপর ফ্রেশ ওয়াটার তথা ব্যবহারযোগ্য পানি বাড়ানোর কোনো উপায় নেই এবং যেহেতু এই ০.৪ শতাংশ ফ্রেশ ওয়াটার তথ্য ব্যবহারযোগ্য পানি নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওর, পুকুর-দিঘী, মাটির নিচে এবং সব ধরনের জলাভূমিতে অবস্থিত এবং যেহেতু ফ্রেশ ওয়াটার তথা ব্যবহারযোগ্য পানির উপরোল্লিখিত ০.৫ শতাংশ যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং এর সর্বোত্তম ব্যবহার মানব জাতির জন্য একান্ত অপরিহার্য এবং সেহেতু সব জলাভূমি, লেক এবং বিল সংরক্ষণ করা আমাদের সবার বেঁচে থাকার জন্য একান্ত অপরিহার্য এবং যেহেতু রিটের প্রতিপক্ষরা (বিবাদীরা) বেআইনিভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় রেস্টুরেন্ট, দোকান-পাট তথা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ দিয়ে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকার মূল্যবান সুপেয় পানি এবং এর উপরিস্থিত ও পারিপার্শ্বিক নান্দনিক সৌন্দর্য দূষণ এবং নষ্ট করছে। হাইকোর্ট রায়ে হাতিরঝিলের পানি এবং এর নান্দনিক সৌন্দর্য ও মহামূল্যবান এই জাতীয় সম্পত্তি সংরক্ষণ ও উন্নয়নে চার দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবাইকে সঞ্চয়ী ও উৎপাদনমুখী হতে হবে: প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধবিআইডব্লিউটিসিতে নতুন চেয়ারম্যান, তিন সংস্থায় এমডি