নিউজ ডেস্ক : দেশে এখন বছরে ডিমের চাহিদা সাড়ে চার কোটি, উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৫ কোটি। তারপরও সংকট দেখিয়ে ডিম আমদানি করতে চায় একটি সিন্ডিকেট।
দেশের প্রান্তিক খামারিদের টিকিয়ে রাখতে এই চক্রটিকে ডিম আমদানির অনুমোদন না দেওয়াসহ সরকারের কাছে সাত দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)।
মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানিয়েছেন ডিলার-খামারিদের সংগঠন বিপিএর সভাপতি সুমন হাওলাদার।
তাদের দাবিগুলো হলো— অসাধু সিন্ডিকেট থেকে পোল্ট্রি সেক্টরকে রক্ষা করতে হবে। ডিম আমদানির পাঁয়তারা যারা করবেন তাদের অনুমতি দেওয়া যাবে না।
খাদ্যের উপর সরকারি ভর্তুকিসহ অন্যান্য ফ্যাসিলিটি বাড়িয়ে মূল্য কমাতে হবে।
পোল্ট্রি নীতিমালা প্রণয়নসহ পোল্ট্রি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করে ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
সব খামারিকে নিবন্ধনের আওতায় আনা। এক্ষেত্রে নিবন্ধন ফি কমিয়ে আনতে হবে।
সহজ শর্তে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত খামার মালিকদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, যাতে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।
সুমন হাওলাদার বলেন, আমরা মনে করি দাবিগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে প্রান্তিক পোল্ট্রি খামার মালিকেরা টিকে থাকবেন এবং সস্তা মূল্যে ডিম ও মাংস সাপ্লাই দিয়ে যেতে পারবেন এবং লাখ লাখ মানুষ কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করতেও পারবেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্প মারাত্মক হুমকির মুখে। কিন্তু দেশবিরোধী কিছু আমদানিকারক বিদেশ থেকে ডিম আমদানির জন্য আবেদন করেছেন। সরকার অনুমতি দিলেই তারা আমদানি করবেন, যা পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের আরেকটি ষড়যন্ত্র বলেই আমরা মনে করি।
বাংলাদেশে ডিমের চাহিদা সাড়ে চার কোটি। আমাদের ডিম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৫ কোটি। তারপরও যারা ডিম সংকট বলছেন এটা তাদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত ধান্দাবাজি। বাজারে চাহিদা কম থাকায় আমাদের দেশে খামারিরা ডিম ও মুরগি বিক্রি করতে পারছে না। তারপরও যারা ডিম ও মুরগির সংকটের কথা বলছেন তারা দেশের প্রান্তিক খামারিদের ধ্বংস করে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন ডিম আমদানি বন্ধ করুন, প্রান্তিক খামারিদের রক্ষা করুন।
চুক্তিবদ্ধ খামারের নামে প্রান্তিক খামারিকে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে স্ট্যাম্প ও চেক নিয়ে প্রতারণা করে গুটিকয়েক কর্পোরেট কোম্পানি বছরে ১ হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে। চুক্তিবদ্ধ খামার করতে না চাইলে খামারি এবং ডিলারদের বিরুদ্ধে কর্পোরেট কোম্পানিরা চেক ডিজঅনার মামলা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
এর মধ্যে প্রমাণিত- ৭১ফিড কোম্পানি ও আলাল গ্রুপ বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত কোটি টাকা খামারিদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
শুধু রংপুর জেলায় চুক্তিবদ্ধ পোল্ট্রি খামারিদের কাছ থেকে ১২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং সব খামারি রাস্তায় রাস্তায় দেউলিয়া হয়ে ঘুরছেন। অনেক খামারি খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। সরকারের কাছে আবেদন জানাই, যাতে করে প্রান্তিক খামারিদের টিকিয়ে রাখার জন্য সব প্রকার লেনদেনে ব্ল্যাংক চেক জমা নেওয়ার ব্যাপারে সরকার তদারিক করে ব্যবস্থা নেবেন এবং প্রান্তিক খামারিদের টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবেন। যাতে সব খামারি টিকে থাকতে পারেন এবং আমরা দেশের আমিষের চাহিদা পূরণ করে যেতে পারি।
দেশে বর্তমানে ডলার সংকট থাকাকালে কেন তারা বিদেশ থেকে ডিম আমদানি করতে চায় তা জানা জরুরি। তাদের ডিম আমদানি মূল বিষয় নয়, কালো টাকা সাদা করা এবং দেশ থেকে টাকা পাচারের চিন্তা করছেন বলে মনে করি।
বাংলাদেশে ডিম ও মাংসের কোনো সংকট নেই। বর্তমানে আমাদের দেশে খামারিরা ডিম বিক্রি করতে পারছেন না। অথচ বর্তমানে ডিমের খামারে রেট স্থান বুঝে ৭ টাকা থেকে ৮ টাকা ৪০ পয়সা, যা উৎপাদন খরচের চেয়েও ২ টাকা ১০ পয়সা কম। ফলে প্রতিদিন খামার মালিকদের লোকসান হচ্ছে। এছাড়া ডিমের অসাধু সিন্ডিকেট ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে কারসাজি করে ডিমের দাম কমিয়ে আবার সেটা কয়েকদিনের মধ্যে বাড়িয়ে অর্থ লোপাট করে থাকে। অথচ ভোক্তাদের বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম খামার রেট ১২০ থেকে ১২৫ টাকা হলেও ভোক্তারা ১৬০-১৭০ টাকা কেজিতে কিনছেন। উৎপাদন খরচ ১৪৫-১৫০ টাকা হলেও প্রতি কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা লোকসান হচ্ছে খামারিদের।
প্রান্তিক খামারিদের একটি ডিম উৎপাদনে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কস্ট ফিডে। আমাদের সব কর্পোরেট কোম্পানিদের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ আমরা তো ফিড উৎপাদন করতে পারি না। ফিড উৎপাদনে কোম্পানিগুলো বছরে সিন্ডিকেট করে বছরে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করে। তারা বছরে এক দিন বয়সের মুরগির বাচ্চায় সিন্ডিকেট করে ৮শ কোটি টাকা লোপাট করে। চুক্তিবদ্ধ খামারিদের কাছ থেকে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয় প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। সব কর্পোরেট কোম্পানিকে দুর্নীতি দমন কমিশনে ডেকে তাদের ব্যাংক হিসাব ও ব্যবসার ধরন দেখা উচিত যাতে করে দুর্নীতি দমন করে প্রান্তিক খামারিদের টিকিয়ে রাখা যায়।
একদিকে খাদ্যের দাম এক দুই মাস পর পরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে ক্ষুদ্র খামারিদের আর টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে খামার মালিক লোকসান করতে থাকলে একসময় ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ কর্ম সংস্থান হারাবে। ইতোমধ্যেই এক লাখ পোল্ট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
এখান থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করা না গেলে অল্পসময়ের মধ্যেই প্রান্তিক খামার বন্ধ হয়ে যাবে। তখন একদিকে যেমন লাখ লাখ মানুষ বেকার হবেন অন্যদিকে প্রোটিন সাপ্লাইয়ে সংকট দেখা দেবে। বাজার কর্পোরেট বা ইন্ডাস্ট্রি আকারে গড়ে ওঠা পোল্ট্রি শিল্পের মালিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে, সেক্ষেত্রে তারা চড়া মূল্যে ডিম ও মাংস বিক্রি করতে থাকবে। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রোটিন খাওয়া সম্ভব হবে না। পুষ্টিহীনতায় পড়বে দরিদ্র জনগোষ্ঠী।