নিজস্ব প্রতিবেদক: সাত মাস আগে এই শিল্পের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক দুই হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করলেও কোনো অর্ডার না পাওয়ায় সেখান থেকে এক টাকাও ঋণ নেননি কোনো শিল্পোদ্যোক্তা। ব্যাংকগুলোও পড়েছে মহাবিপদে। প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। কোনো ঋণ আদায় হচ্ছে না। বাড়ছে খেলাপি ঋণের অঙ্ক।
রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি নিয়ে আশা জাগিয়েছিল যে জাহাজ রপ্তানি, তা তছনছ করে দিয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ডুবতে বসেছে জাহাজ নির্মাণশিল্প খাত। গত তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে এ শিল্পের কিছু নির্মাণ সরঞ্জাম রপ্তানি হলেও পূর্ণাঙ্গ কোনো জাহাজ রপ্তানি হয়নি।
সাত মাস আগে এই শিল্পের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক দুই হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করলেও কোনো অর্ডার না পাওয়ায় সেখান থেকে এক টাকাও ঋণ নেননি কোনো শিল্পোদ্যোক্তা। ব্যাংকগুলোও পড়েছে মহাবিপদে। প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। কোনো ঋণ আদায় হচ্ছে না। বাড়ছে খেলাপি ঋণের অঙ্ক।
তিন বছর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাহাজ রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ ১ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় করেছিল, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এই খাত থেকে আসা সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা। বিশ্ববাজারে সম্ভাবনা থাকায় এবং আশা জাগানিয়া এই খাত থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার ধরা হয়। কিন্তু ওলটপালট হয়ে যায় সব হিসাব-নিকাশ; কালো মেঘ নেমে আসে এই খাতে। করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এখনো চলছে।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় মাত্র ২ হাজার ডলার। মহামারির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নামমাত্র এই লক্ষ্য ধরে সরকার। মহামারির ধকল কমবে- এই প্রত্যাশায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্য কিছুটা বাড়িয়ে ৩ হাজার ডলার ধরা হয়। কিন্তু ২০২০ সালের প্রথম দিকে বিশ্বে করোনা মহামারি শুরুর পর এই তিন বছরে কোনো জাহাজ রপ্তানি হয়নি।
দেশের সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মাতা ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের পরিচালক এবং রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের (এইওএসআইবি) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সব শেষ…। গত তিন বছরে কোনো জাহাজ রপ্তানি করতে পারিনি আমরা। শুধু আমরা নই, কেউই কোনো জাহাজ রপ্তানি করেননি। সত্যিই বেহাল দশা আমাদের এই শিল্পের। চূড়ান্ত খারাপ অবস্থা। এমন নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হব- কখনোই ভাবিনি আমরা। করোনা আর যুদ্ধ আমাদের শেষ করে দিয়েছে। জানি না ভবিষ্যৎ কী? আর কখনো আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব কি না, জানি না।’
‘আমাদের কারণে ব্যাংকগুলোও বিপাকে পড়েছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ব্যাংকগুলো সব মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছিল। সুদ-আসলে তা বেড়ে এখন ২৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আমরা কেইউ সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছি না। খেলাপি হয়ে যাচ্ছি। কারখানা, অফিস ঠিকমতো চালু রাখতে পারছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বেকার হয়ে যাবেন।’
বেশ কিছুদিন ধরে সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জোর দিচ্ছে বিশ্বের উপকূলীয় দেশগুলো। সমুদ্র থেকে মৎস্য ও খনিজসম্পদ আহরণ, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক পর্যটন, সমুদ্র নিরাপত্তা ও গবেষণা ঘিরে বাড়ছে এসব কর্মকাণ্ড। সমুদ্র অর্থনীতির এসব কর্মকাণ্ডের জন্য দরকার উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত ছোট-বড় জাহাজ।
পণ্যবাহী জাহাজ রপ্তানি বাজারের মতো উত্থান-পতন নেই উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত জাহাজের রপ্তানির বাজারে। তাই সম্ভাবনাময় এই রপ্তানির বাজার ঘিরেই আগ্রহ বেড়েছিল বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর। সরকারও এ খাতের রপ্তানি বাড়াতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা, কর ছাড়সহ নানা প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। ব্যাংকগুলোও মোটা অঙ্কের অর্থায়ন করেছে এই খাতে। ২০২১ সালের প্রথম দিকে সরকার একটি নীতিমালা করে দিয়েছে। তাতে জাহাজ রপ্তানি থেকে বছরে ৪ বিলিয়ন ডলার আয় হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছে।
এক যুগ আগে ২০০৭ সালে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ রপ্তানির মধ্য দিয়ে জাহাজ রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। জার্মানিতে জাহাজ রপ্তানির ফলে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন একটা বার্তা যায় যে, দেশটি বিশেষায়িত এই শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছে। এতে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়।
কিন্তু ২০০৮ সালে শুরু হওয়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং ২০১০ সালে ইউরো জোনের মন্দার কারণে সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। সমুদ্রগামী জাহাজের ৭০ ভাগের মালিকানা ইউরোপের দেশগুলোর। ওই সময়ে ইউরোপের ব্যাংকগুলো জাহাজ কেনায় অর্থায়ন বন্ধ রাখে। জাহাজ ভাড়াও ৭৫ শতাংশ কমে যায়।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘যে সময় জাহাজ রপ্তানি টেক অব করবে, সেই সময়ই ওই ধাক্কা আসে। ২০১০ সালের পর থেকে আমরা টুকটাক করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আসছিলাম। আমরা ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিলামও। ২০২০ সালে ভারতের জিন্দাল স্টিল ওয়ার্কস চারটি আট হাজার টনের জাহাজ নিয়েছিল। ওই রপ্তানির মধ্য দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছিলাম, বাংলাদেশ শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যই উৎপাদন করে তা নয়, উচ্চ প্রযুক্তির ভারী শিল্পপণ্যও এখানে তৈরি হচ্ছে। জার্মানি, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, কেনিয়া, পাকিস্তানেও আমাদের জাহাজ রপ্তানি হয়েছে। এসব জাহাজের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজের পাশাপাশি যাত্রীবাহী, বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী, মাছ ধরার জাহাজ এবং যুদ্ধজাহাজও ছিল।’
‘কিন্তু কোভিড-১৯ সবকিছু শেষ করে দিয়েছে’ মন্তব্য করে সাখাওয়াত বলেন, ‘আমরা যখন জাহাজ তৈরি করি, তখন যে প্রতিষ্ঠানের জাহাজ তৈরি করি সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। এমনকি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত থাকেন। ২০২০ সালের মার্চের পর থেকেই তারা চলে গেছেন। আমাদের সব কাজ বন্ধ। জাহাজের মোট রপ্তানির ৭০ শতাংশই রপ্তানি হয় ইউরোপের দেশগুলোতে। করোনার পর যুদ্ধের ধাক্কায় ইউরোপের দেশগুলো অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ওই সব দেশের মানুষ এখন খাদ্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছেন। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ইউরোপে জাহাজ রপ্তানি নিয়ে কোনো আশা আমি দেখছি না।’
এইওএসআইবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র দুই-তিনটি প্রতিষ্ঠান জাহাজ রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। তবে রপ্তানি করতে সক্ষম এমন কারখানা আছে দেশে ১০টি। এর মধ্যে দেশে ব্যবহারের জন্য বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণ করে ইতিমধ্যে দক্ষতা দেখিয়েছে বেশ কয়েকটি কারখানা। দেশের জন্য তৈরি করা হলেও এসব জাহাজ নির্মাণে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হয়েছে কারখানাগুলোকে।
এ ছাড়া কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড লিমিটেড নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে তিনটি কারখানায় খননকারী জাহাজ (ড্রেজার) নির্মাণ করছে। বেসরকারি খাত ছাড়াও নৌবাহিনী পরিচালিত তিনটি ইয়ার্ডও নিজেদের ব্যবহারের জন্য যুদ্ধজাহাজসহ বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণে সক্ষমতা দেখিয়েছে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী, জাহাজ নির্মাণ খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন, কোরিয়া ও জাপান। বিশ্বের মোট জাহাজ নির্মাণের ৯০ দশমিক ৫ শতাংশ হয় এই তিনটি দেশে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাহাজ রপ্তানি থেকে ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাত থেকে রপ্তানির লক্ষ্য ধরা হয় ৫০ লাখ ডলার। বছর শেষে সেই লক্ষ্য থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ১ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার দাঁড়ায়, যা ছিল এ যাবৎকালে জাহাজ রপ্তানি থেকে সবচেয়ে বেশি আয়। ওই অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছিল ১৪০ শতাংশ।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘গত তিন বছরে আসলে কোনো জাহাজ রপ্তানি হয়নি। আগে রপ্তানি করা জাহাজের কিছু অর্থ দেশে এসেছে। আর জাহাজ নির্মাণের কিছু সরঞ্জাম রপ্তানি করে কিছু বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে।’
বাংলাদেশ ছোট ও মাঝারি মানের সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরি করে। বিশ্বব্যাপী এ ধরনের জাহাজের চাহিদা বেশি, যার বাজার ২৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো।
জাহাজ নির্মাণশিল্পের উন্নয়নে চলতি বছরের মে মাসে দুই হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাহাজ নির্মাণশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০২১-এর আওতায় এ তহবিল গঠন করা হয়। জাহাজ নির্মাণকারী রপ্তানিমুখী ও স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ জাহাজ নির্মাণশিল্পের উন্নয়ন, পরিচালনা ও বিকাশের জন্য এ তহবিল থেকে ঋণ মিলবে। তহবিলটির আওতায় সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ মিলবে। আর ব্যাংকগুলো ১ শতাংশ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা নিতে পারবে। তবে এই তহবিল থেকে এক টাকা ঋণ নেয়নি জাহাজ নির্মাণ উদ্যোক্তা।
এ প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘অর্ডার নেই। ঋণ নিয়ে কী করব। আগের ঋণই তো শোধ করতে পারছি না। সুদ বাড়ছে, আসল বাড়ছে। খুবই বিপদে আছি আমরা। সরকারকে অনুরোধ করছি, আমাদের দিকে তাকাতে। আমাদের সুদটা মাফ করে দিতে হবে। তা না হলে এই খাত আর কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।’
অর্থনীতির গবেষক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যিই একটা ভালো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল এই খাতে আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো সুনাম অর্জন করেছিলেন আমাদের রপ্তানিকারকরা। কিন্তু করোনার ধাক্কা কাটতে না কাটতেই যুদ্ধ এই শিল্পকে বড় ধরনের সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে।’
‘তবে সামনে সুদিন আসবে। পরিস্থিতি ভালো হলে আবার বাড়বে জাহাজ রপ্তানি। সেদিন পর্যন্ত এ খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর সেজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ওষুধ দিতে হবে। সুদ মওকুফ, প্রণোদনাসহ নানা ধরনের সহায়তা করা যেতে পারে।’