
নিউজ ডেস্ক : দেশের মানুষ প্রতিদিন যেসব খাবার গ্রহণ করে তার মধ্যে সবজি অন্যতম। শরীর সুস্থ রাখতে পরিমিত পরিমাণ ফলের সঙ্গে সবজি খাওয়ারও বিকল্প নেই। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী ও খাদ্য প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষক মো.হাফিজুল হক খান জানান, দেহ গঠন ও পুষ্ঠির চাহিদা পূরণেও দরকার সবজি ও ফল।
প্রতিদিন এদেশের মানুষ কমবেশি সবজি খায়, যা শরীরের জন্য যথেষ্ট নয়। এছাড়া এমন অনেকেই আছে যারা সবজি খেতে একেবারেই পছন্দ করেনা। বিশেষ করে শিশু ও উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা সবজিকে এড়িয়ে চলে। এতে তারা ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, ফাইবার, এন্টি-অক্সিডেন্ট, ফেনলিক উপাদানসহ অন্যান্য পুষ্ঠিগুণাগুণ থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২-এর তথ্য মোতাবেক ২০২০-২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৪.৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ৪৭.৩০ লাখ টন সবজি উৎপাদিত হয়। উৎপাদনের হার প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০.৪১ টন। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী একজন মানুষের বছরে ১৪৬ কেজি ফল ও সবজি খাওয়া দরকার, খায় অর্ধেক এরও কম (৭০ কেজি)। ২০১০-২০১৮ এর তথ্য বিশ্লেষণমতে সবজি কম খাওয়ার প্রবণতায় ক্যান্সারের ঝুঁিক বাড়ছে, এতে বছরে প্রায় ১০ লাখ মানুষ ক্যান্সারেই মারা যাচ্ছে।
গবেষণা তথ্যের পর্যবেক্ষণমতে যথাযথ পুষ্টি ঘাটতির জন্য অন্ধত্ব, হাড়ক্ষয়, কোষ্ঠকাঠিন্য, আলসার, উচ্চ রক্তচাপ, দেহের রক্তস্বল্পতা, হৃদরোগের ঝুঁকি, বার্ধক্যসহ বহুবিধ রোগ হতে পারে। বিভিন্ন জরিপমতে সবজির যথাযথ সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিবছর প্রায় ২০ থেকে ৪৫ ভাগ পর্যন্ত গুণগত ও পরিমাণগত অপচয় হয়ে থাকে, যা টাকার অংকে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এমনকি ভরা মৌসুমে সবজির মূল্য ক্রমেই কমতে থাকে ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। তখন কৃষকের মজুরি পর্যন্ত উঠে না ফলে কৃষক ক্ষেতেই অনেক সময় সবজি রেখে আসে।
পরিচর্যা ও প্যাকেজিং করে বিভিন্ন শাকসবজির সংরক্ষণকাল বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষকদের এ দূ:খের অবসান হতে পারে। দেশের আবহাওয়ায় উৎপাদিত অধিকাংশ শাকসবজি মাঠ থেকে সংগ্রহের পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সাধারণত ২ থেকে ৩ দিনের বেশি সতেজ ও খাবার উপযোগী থাকে না। মাঠ থেকে সংগ্রহের পর প্রতি লিটার পানিতে ২০০ পিপিএম ক্লোরাক্স দ্রবণ বা ২ থেকে ৩টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে ধুয়ার পর মুখবন্ধ ৩৫ থেকে ৪০ মাইক্রন পুরুত্বের পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে পুঁইশাক, কাঁচামরিচ, ঢ়েড়স ও লালশাক যথাক্রমে ৮ দিন, ১০ দিন, ১১ দিন এবং ৭ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে। অন্যদিকে ১.৫শতাংশ ও ১.০শতাংশ ছিদ্রযুক্ত ও মুখ বন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে ৯ দিন পর্যন্ত যথাক্রমে ঝিঙা ও ধুন্দুল স্বাভাবিক তাপমাত্রায় শুকনো জায়গায় সংরক্ষণ করা যায়।
এনজাইম নিস্ক্রিয়করণের মাধ্যমে বিভিন্ন সবজির সংরক্ষণকাল বাড়ানো যায়। এসব সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মটরশুঁটিসহ অন্যান্য কাঁচা শাকসবজিকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় (৬০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড বা বেশি) ব্লাঞ্চিং এর (৩০ সেকেন্ড থেকে ৩ মিনিট) মাধ্যমে এনজাইম নিষ্ক্রিয়করণ করে সবজির সংরক্ষণকাল ৬ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত বাড়ানো যায়। যা পরে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য তৈরি বা অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যের কাঁচামাল হিসেবে দীর্ঘ সময় ব্যবহার করা যায়। পাকা গাজর ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মিনিট ব্লাঞ্চিং করে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় ৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়। মিশ্র সবজির আচার, চাটনি, সাওয়াক্রাউট (বাঁধাকপি দিয়ে তৈরি ফার্মান্টেড খাবার), কিমচি (গাঁজন করা শাকসবজি), পেস্ট বা পাউডার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
শুষ্কীকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন সবজির সংরক্ষণকাল বাড়াতে শাকসবজিকে নির্দিষ্ট আকৃতিতে কেটে টুকরা টুকরা করে ব্লাঞ্চিং বা শোধন করলে এনজাইম নিষ্ক্রিয় হয়। এসময় কিছুক্ষণ ঠান্ডা পানিতে রেখে পরে পরিচর্যা করে সোলার বা কেবিনেট ড্রাইয়ারে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় শুকালে গুণগতমান বজায় থাকে। এভাবে কাঁচা কাঁঠাল, গাজর, কাঁচা পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো ইত্যাদি যথাযথভাবে শুকিয়ে মোড়কজাত করলে দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা যায়।
জিরো এনার্জি কুল চেম্বারেও বিভিন্ন সবজি সংরক্ষণ করা যায়। জিরো এনার্জি কুল চেম্বার হলো বাঁশ ও ছন বা খড় দিয়ে নির্মাণ করা ঘরের মধ্যে ইট, বালু ও সিমেন্টে নির্মিত দু’টি দেওয়াল ঘেরা চেম্বার বিশেষ। দেওয়াল দু’টির মাঝখানের ফাঁকা জায়গা বালি দিয়ে পূরণ করা হয় এবং সকাল-সন্ধ্যায় এবালি পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হয়। বাষ্পীভবনের নীতি অনুযায়ী এচেম্বারের ভেতরে তাপমাত্রা মৌসুমভেদে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ১২-১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত কমে যায় এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ১০-১২শতাংশ থেকে ২৫-৩০শতাংম পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে চেম্বারের ভেতরে রাখা পচনশীল পণ্যের সংরক্ষণকাল বাড়ানো যায়। গবেষণা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, জিরো এনার্জি কুল চেম্বারে রাখা বিভিন্ন সবজি যেমন-লালশাক, গিমাকলমী, করলা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও টমেটো পণ্যের প্রকৃতি ও মৌসুম ভেদে ২-১৬ দিন পর্যন্ত বিক্রয় যোগ্য রাখা যায়।
‘কুলবট’ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন সবজি সংরক্ষণ করা হয়। কুলবট প্রযুক্তি মূলত কোল্ডস্টোরেজ একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। বিভিন্ন সবজি বেশি সময় সংরক্ষণের জন্য স্বল্প ব্যয়ে তৈরি করা যায়। এই প্রযুক্তিতে কুলবট নামক একটি ছোট্ট ডিভাইস সাধারণ এয়ার কন্ডিশনারের সঙ্গে স্থাপন করে একটি সাধারণ এয়ার কন্ডিশনারের তাপমাত্রা সীমা ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে কমিয়ে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত নামিয়ে আনা যায়। ফলে এই বিশেষ যন্ত্রটি ইনসুলেটেড বা বায়ুরোধক কক্ষে স্থাপিত এয়ার কন্ডিশনারের সঙ্গে যুক্ত করে কক্ষটিকে কোল্ডরুমে রূপান্তর করা যায় এবং উল্লেখযোগ্য স্বল্প খরচে কোল্ড স্টোরেজের সুবিধা এখানে পাওয়া যায়। কুলবট কোল্ড স্টোরেজ প্যাক-হাউজ কিংবা পাইকারি বাজারে স্থাপন করা যেতে পারে।
বিভিন্ন সবজির আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি, প্রিজার্ভ, কেন্ডি, চিপ্স তৈরিকরণ: বিভিন্ন শাকসবজিকে পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মসলা, লবণ, চিনি, এসিটিক এসিড ইত্যাদি মিশিয়ে উৎকৃষ্টমানের স্বাদ, গন্ধযুক্ত আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি, কেন্ডি, চিপ্স তৈরিকরণ করা যায়। মিশ্র সবজির আচার তৈরির জন্য প্রথমেই পরিমাণমত মটরশুঁটি, ফুলকুপি, সিম ও গাজর ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। অতঃপর টুকরোগুলো ওজন নিয়ে তেলে ভেজে নিতে হবে। পরিমাণমত আদা ও রসুন ১০০ সিসি ১শতাংশএ্যাসেটিক এসিডসহ বেটে পেস্ট তৈরি করতে হবে এবং সসপেনে বাকি তেল গরম করে নিতে হবে। এখন আদা-রসুন পেস্ট, কাঁচামরিচ, ভাজা সবজির টুকরো, চিনি, মরিচের গুঁড়া, সরিষার গুঁড়া, হলুদের গুঁড়া, জিরার গুঁড়া ইত্যাদি এক এক করে সসপেনে ঢালতে হবে এবং সামান্য জ্বাল দিতে হবে। শেষে লবণ এবং অবশিষ্ট এসেটিক এসিড যোগ করতে হবে এবং জ্বাল দিতে হবে। মিশ্র সবজি মসলাসহ ঘন হয়ে আসলে বা আচার ঘন হয়ে এলে জ্বাল বন্ধ করতে হবে এবং গরম অবস্থায় বয়ামে ভরে বোতলের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে তৈরিকরা আচার ভর্তি বয়াম ঘরের শুকনো এবং ঠান্ডা জায়গায় ১০-১২ মাস স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়। এছাড়া স্টিপিং পদ্ধতিতে সবজি সংরক্ষণের জন্য লবণের দ্রবণ আদিকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমান বৈষ্ণিক প্রেক্ষাপটে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অপচয়রোধের কোন বিকল্প নেই।