নিউজ ডেস্ক : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী কর জিডিপি’র অনুপাত ৯ দশমিক ৫ ভাগে উন্নীত করতে হলে আগামী তিন বছরে এনবিআরকে অতিরিক্ত দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় আইএমএফ শর্ত পূরণ করতে আগামী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ৬৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে হবে।
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বনানীতে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, আইএমএফ-এর এই শর্ত মানতে হলে করহারসহ করের আওতা বাড়াতে হবে। আর এতে করে চাপে বাড়বে দেশের জনগণের ওপর। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ও গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক।
পিআরআই’র পক্ষ থেকে বলা হয়, আইএমএফ-এর শর্ত মেনে ২০২৪, ২০২৫ এবং ২০২৬ অর্থবছরে বাজেটের মূল রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ২৩৪০ বিলিয়ন টাকা বা ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে হবে। এর মধ্যে ২০২৪ অর্থবছরে অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
শর্ত অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন। তবে অর্জন না করে উপায় নেই। গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক জানান, আইএমএফ-এর ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে শর্ত অনুযায়ী জিডিপিতে করের অবদান সাত দশমিক ৮ থেকে ২০২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক তিন শতাংশ, ২০২৫ অর্থবছরে ৮.৮ শতাংশ এবং ২০২৬ অর্থবছরে নয় দশমিক পাঁচ শতাংশে উন্নতি করতে হবে। এর পরের বছরগুলোতে এই আয় আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট ।
পিআরআই বলছে, রাজস্ব আয় বাড়াতে আইএমএফের পক্ষ থেকে এখনও সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা না পাওয়া গেলেও বাজেটের আগে ধাপে ধাপে তা আসবে। তবে আইএমএফের চাপে নয়; বরং নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতেই এই সংস্কার করা প্রয়োজন।
পিআরআই পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, উচ্চ মধ্যম দেশে পরিণত হওয়ার জন্য সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকীর তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সাল শেষে কর-জিডিপির অনুপাত সাড়ে ১২ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। সুতরাং আইএমএফ-এর ঋণ কর্মসূচি অনুযায়ী সরকার যদি শর্ত পূরণ করে তারপরও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকীর লক্ষ্য অর্জন হবে না। তাই শুধু আইএমএফ-এর শর্ত পূরণই নয় দেশের স্বার্থেই প্রয়োজনীয় সংস্কার করে রাজস্ব বাড়াতে হবে।
আহসান এইচ মুনসুর বলেন, দেশে বর্তমানে জিডিপির তুলনায় যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয় তা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের চেয়ে কম। রাজস্ব আহরণ হয় না তাই সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করতে পারে না। তাই অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গিকার দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, যেসব ক্ষেত্রে করছাড় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে রাজস্ব বাড়ানো যায়। এছাড়া, দেশের আয়কর দিতে সক্ষম এমন প্রতিটি মানুষকে করের আওতায় আনা গেলে জিডিপির আড়াই থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব। তাই এ বিষয়ে এনবিআরকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে কর্পোরেট কর থেকে আরও রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
করছাড় প্রসঙ্গে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন ঢালাওভাবে ছাড় প্রত্যাহার করা যাবে না। তবে কি পরিমাণ ছাড় দেওয়া হচ্ছে তা নির্ধারণ করে প্রতিটি বাজেটে উপস্থাপন করা উচিত। একই সঙ্গে যেসব জায়গায় ছাড় প্রত্যাহার করা সম্ভব সে জায়গাগুলো ধীরে ধীরে ছাড় কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন তিনি।
রাজস্ব বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জিডিপির তুলনায় দশমিক ৫০ শতাংশ রজস্ব প্রবৃদ্ধি আপাতত দৃষ্টি খুব বেশি মনে না হলেও বিদ্যামন রাজস্ব কাঠামোতে এটি অর্জন করা খুবই কঠিন। অন্যান্য দেশের বিভিন্ন খাতে করহার কম থাকায় প্রয়োজন হলেই তারা সেটি বাড়াতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যমান করহারের পরিমাণই বেশি। তাই এনবিআর-এর কাঠামোগত সংস্কার ও মানসিকতার বদল করা না গেলে আইএমএফ-এর শর্ত মেনে রাজস্ব খাতের সংস্কার বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য কঠিন হবে বলে তিনি শঙ্কা ব্যক্ত করেন।
এম এ রাজ্জাক তার উপস্থাপনায় বলেন, রাজস্ব খাতের ক্ষেত্রে আইএমএফ-এর সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জের হবে। তবে এটা অসম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। তবে সব ছাপিয়ে যে আলোচনা এখন প্রাধান্য পাবে, তা হচ্ছে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর-কে বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ৬৫০ বিলিয়ন বা ৬৫ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে।
পিআরআই গবেষণা পরিচালক আরও বলেন, এর পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুনে সমাপ্ত বছরে বর্তমান বছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে হবে ১ হাজার ৩৮৩ বিলিয়ন টাকা বা ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩০০ কোটি কোটি টাকা।
আইএমএম-এর ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর, ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে এনবিআর-কে বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অতিরিক্ত আরও ২ হাজার ৩৪০ বিলিয়ন টাকা বা ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
উল্লেখ্য, চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআর-কে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে।