নিজস্ব প্রতিবেদক : এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, দর্জি ব্যবসা কমে যাওয়ার কারণ ট্যাক্স বা ভ্যাটের লোডের কারণের নয়, এটা ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর (উন্নয়নের নির্দেশক)।
রোববার (৫ মার্চ) সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব ভবনে বাংলাদেশ ড্রেস মেকার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ ১৪টি সংগঠনের সঙ্গে প্রাক-বাজেট সভায় তিনি এ কথা বলেন।
আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান ছাড়াও শুল্ক বিভাগের সদস্য মো. মাসুদ সাদেক, ভ্যাট নীতির সদস্য জাকিয়া সুলতানা ও আয়কর নীতির সদস্য সামস উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। এসময় বাংলাদেশ ড্রেস মেকার্স অ্যাসোসিয়েশন টেইলারিং অ্যান্ড টেইলার্স সেবাখাতে ৩০ শতাংশ মূল্য ভিত্তি ধরে নিট মূল্য সংযোজন ভিত্তিতে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ মূসক ধার্য করার প্রস্তাব দেন।
সংগঠনের সেক্রেটারি হারুন উর রশিদ বলেন, ‘বর্তমান বাজারে চীন থেকে আমদানি করা শার্ট, প্যান্ট, ব্লেজার কম দামে পাওয়া যাওয়ায় দর্জি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ে পোশাক ডেলিভারি করা সম্ভব হয় না। ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পোশাক সরবরাহবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে, যা দুই তিন বছর পর নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে হয়। বর্তমানে আমাদের ওপর ১০ শতাংশ হারে মূসক ধার্য করা রয়েছে, যা লভ্যাংশ থেকে প্রদান করা কঠিন।’
জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘ড্রেস মেকার্স যারা তাদের যে সমস্যার কথা বলছেন বা তাদের অর্ধেক ঝরে গেছেন, এটা কিন্তু ট্যাক্স বা ভ্যাটের লোডের কারণের নয়। এটা একটা ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর। এটা উন্নয়ন মাপকাঠি যে, আমি দোকান থেকে গজ কাপড় কিনি এবং মেকারের কাছে গিয়ে বলি ভাই এটা বানিয়ে দাও। নাকি আমি সরাসরি আমার পোশাক কিনি। চয়েজ করে কালার, মাপ দেখে একটা কিনি, টাকা দিয়ে দেই। এটা হলো একটা ইন্ডিকেটর যে, একটা দেশ উন্নত হচ্ছে। যত দেশ যত উন্নত হবে তত থান কাপড় কিনে দর্জির কাছে যাওয়ার মতো সময়টা থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমি একবার যাবো থান কাপড় কিনতে, সেটা নিয়ে বাড়ি এসে দুই দিন পর যাবো দর্জির কাছে। তারপর আবার দর্জির কাছে গিয়ে ট্রায়াল দেবো। তারপর সেটা নেবো। এ সময়টা আমি অন্য জায়গায় ব্যবহার করলে এর চেয়ে বেশি পয়সা কামাই করবো। দেশ যত উন্নত হবে, ড্রেস মেকিং ইন্ডাস্ট্রিতে তত চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে সারভাইব করার। এখন আপনাদের সারভাইব করতে অন্য প্রসেসে যেতে হবে। ট্যাক্স, ভ্যাট দিয়ে সারভাইব করা আপনাদের সাপোর্ট করা যাবে না।’
ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইমরান হোসেন খামার মালিকদের আগামী ২০ বছরের জন্য আয়কর রেয়াত ও দেশীয় উৎপাদিত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য ও মাংসের ওপর সব ভ্যাট প্রত্যাহার চেয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশ মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ উল্লেখ করে সাফটা চুক্তি থেকে হিমায়িত মাংস আমদানি বাতিল ও অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেন মোহাম্মদ ইমরান।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি স্ট্রিট ফুডসহ সব খাদ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় আনা ও শতভাগ রেস্তোরাঁকে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসের আওতায় আনার প্রস্তাব দেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের ক্যান্টিনে ভ্যাট হার ১ শতাংশ ও ক্যাটারিং সার্ভিসে খাবার সরবরাহের ক্ষেত্রে ভ্যাট হার ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) কৃষিজ পণ্য সরবরাহের বিপরীতে উৎসে কর কর্তনে অব্যাহতি প্রদান, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান উপকরণ হিসেবে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার দাবি করেছে।
সংগঠনটির সদস্য ও প্রাণ আরএফএল গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার মোল্লাহ আসেফ হোসেন বলেন, ‘পাউরুটি, হাতে তৈরি বিস্কুটের প্রধান কাঁচামাল আটা, ময়দা, চিনি ও তেল ইত্যাদির আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারমূল্য দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে এস আরও’তে সেসব পণ্যের যে মূল্য নির্ধারিত আছে, বর্তমানে সেই ব্যবহৃত কাঁচামালের মূল্যই তার চেয়ে বেশি। এসব কাচামালের এস আরও মূল্য বাড়ানো দরকার। পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এসেপটিক প্যাক আমদানি শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাব করেন তিনি।’
হজ এজেন্সিস অব বাংলাদেশ (হাব) এজেন্সিগুলোর জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি কেনার সুবিধা প্রদানের আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ সিকিউরিটি সার্ভিসেস কোম্পানিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন করপোরেট কর, মূসক, উৎস কর ও টার্নওভার করা ০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রস্তাব শুনে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইমপোর্ট করা গুঁড়াদুধ আমরা চাই না। এ জায়গাটা দেখতে হবে। গুড়াঁদুধের প্রোডাকশনের জায়গা তৈরি করতে হবে। সেখানে সাপোর্ট দেওয়ার প্রয়োজন।’
রেস্টুরেন্টের ভ্যাট প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৫ থেকে ১০ এ, সেখান থেকে ৫ আনলাম। এখন বলছে ৩ শতাংশ করেন। ৩ শতাংশ করার সঙ্গে সঙ্গে বলবেন ০ করেন।’
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যার যার জায়গা থেকে আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করছেন। আমরাই সব রাজস্ব দিচ্ছি, ভ্যাট দিচ্ছি এমন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। পোল্ট্রি ফিশারিজে আমরা বরাবরই সাপোর্ট দিয়ে আসছি। মেশিন বানানোর স্ক্রুটাকে ডিউটি ফ্রি করে দেওয়ার কথা বলছেন। সব আইটেমকে ডিউটি ফ্রি সুবিধা দিতে হবে- এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ডিক্লারেশন নেবেন, সেগুলো নিয়ে আসবেন। কিন্তু সেই ডিক্লারেশনের জায়গায় আপনারা থাকেন না। আপনারা বলেন, স্ক্রু আছে, সেগুলো ছাড় হচ্ছে না। আপনি তো আগে বলেন না, কয়টা লাগবে বা কী লাগবে। অনবরত বস্তা বস্তা স্ক্রু আনলে সেটা আমাদের দেখতে হবে না।’
রহমাতুল মুনিম আরও বলেন, ‘অনেক এজেন্সি থেকে এনওসি নিতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন। এটা সিস্টেম জটিলতা ও সমস্যা তৈরি করে। আমাদের কাস্টমসের তরফ থেকে এসব সমস্যা সৃষ্টি করে না। সেখানে আমাদের বলা আছে যে, এই এই সেফটি মেজারস নিতে হবে, এই এই বিষয়ে ছাড় হবে। নিয়স্ত্রক সংস্থাগুলো এত জটিলতা বা কড়াকড়ি আরোপ করবে না, যদি ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট সততা দেখাতে পারেন। আপনারা যেটা বলছেন, যেটা ডিক্লেয়ার করছেন ওই জিনিসই আসছে। তাহলে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হবে। তখন হয়তো এ কড়াকড়িটা উঠে যাবে। বিজনেস কমিউনিউটির সততা দেখাতে হবে। এখানে প্রচুর অসততা আছে, আপনারা অস্বীকার করতে পারবেন না। এখন আমরা সেই জায়গায় আসিনি।’