নিউজ ডেস্ক : প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুতে উঠলো ট্রেন। এর মাধ্যমে ঐতিহাসিক মাইলফলক স্পর্শ করলো পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু ঘিরে দেশের আধুনিক রেল নেটওয়ার্কের খবরে আনন্দে উচ্ছ্বসিত পদ্মা পাড়ের মানুষ।
মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দুপুর ১টা ২১ মিনিটে ভাঙ্গা স্টেশন থেকে ট্রেনটি মাওয়া স্টেশনের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলে দুপুর ২টা ৪৩ মিনিটে পদ্মা সেতুতে ওঠে।
এর আগে পরীক্ষামুলক ট্রেন চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন। আশা করি, তিনি নির্ধারিত সময়ে সেপ্টেম্বরে ভাঙ্গা ঢাকা অংশের ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করবেন। আর ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চলাচল আগামী বছরের নির্ধারিত সময়েই শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক এই ট্রেন সফরে আরও ছিলেন জাতীয় সংসদে চিফ হুইপ নুর ই আলম চৌধুরী লিটন, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ইকবাল হোসনে অপু, সংসদ সদস্য মজিবুর হোসেন চৌধুরী নিক্সন প্রমুখ।
এক সময় যে পদ্মা সেতু ছিলো দেশের মানুষের কল্পনায়, তা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তীরে বসে অপেক্ষার প্রহরগোনা মানুষগুলো এখন নদী পার হয় নিমিষেই। এবার প্রমত্তা সেই পদ্মার কলতানের সঙ্গে যোগ হলো রেলের কুঁ ঝিক ঝিক। পদ্মার বুকে এখন চলবে ট্রেনও।
সরকার ২০১৬ সালের মার্চে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের অনুমোদন দেয়। পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে নয় মাস আগে। এবার ট্রেন চলাচলের জন্যও প্রস্তুত দেশের দীর্ঘতম এ সেতু।
পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাঈদ আহম্মেদ জানান, গ্যাংকার দিয়ে ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত সাড়ে ৪১ কিলোমিটার রেলপথ পরীক্ষা করে দেখবো। এ পথে ডিজাইন-স্প্রিড ১২০ কিলোমিটার থাকলেও ৩০-৪০ কিলোমিটার বেগে টেস্ট-রান চালানো হবে।
পদ্মা সেতুর রেলপথ চালু আরও এক শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি করবে বলেও জানান তিনি।
এই রেল ট্রান্স এশিয়া রেলপথের সঙ্গে এ লাইনটি যুক্ত হবে জানিয়ে সাঈদ আহম্মেদ বলেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদার চীনের চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিআরইসি)। আর পুরো প্রকল্প তদারকি করছে সিএসসি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন জানান, পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাংকার ট্রেনটি ভাঙ্গা থেকে রওনা হয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে মাওয়া আসে। ট্রেনটি মূলত নির্মিত রেলপথ ইন্সপেকশনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এই ট্রেনে ভ্রমণ করে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন নির্মিত রেলপথসহ প্রকল্পের সার্বিক কাজ পরিদর্শন করেন।
তিনি জানান, আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে। অন্যদিকে প্রকল্পের মেয়াদ অনুযায়ী ২০২৪ সালের জুনে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত পুরো রেলপথটি চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২০৩০ সাল নাগাদ রেলপথটির ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে প্রতিদিন ১৩ জোড়া ট্রেন চলবে।
একইভাবে ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে প্রতিদিন সাত জোড়া ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে প্রতিদিন চলবে পাঁচ জোড়া ট্রেন। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে বছরে ৪০ লাখ, ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে বছরে ১৭ লাখ ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ যাত্রী পরিবহন করা হবে। ‘ওয়ান-ডিরেকশন’ বা একমুখী চলাচলের ওপর ভিত্তি করে প্রাক্কলনটি তৈরি করেছে সিআরইসি।
আনুষ্ঠানিকভাবে এই ট্রেনই প্রথমবারের মতো সেতু অতিক্রম করছে। তবে ২৯ মার্চ সেতুর ২৫ নম্বর খুঁটির কাছে বাকি থাকা ৭ মিটার রেলপথ নির্মাণ শেষ হওয়ার ৭২ ঘণ্টা পরও রেল ট্র্যাক মহড়া হিসাবে সেতুতে চলাচল করেছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছেন।
প্রকল্প কর্মকর্তারা আরও জানান, যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ লেভেল ক্রসিংবিহীন রেল সংযোগ প্রকল্পের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পদ্মা সেতুতে পাথরবিহীন নির্মাণ। আর সেই রেলপথ সুচারুরূপে সম্পন্ন হওয়ায় দেশের আধুনিক রেল নেটওয়ার্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকায় যশোরের সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ স্থাপনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে। চীন সরকার মনোনীত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড চায়না জিটুজি সিস্টেমের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পটি সম্পন্ন করার পর, রেল যোগাযোগব্যবস্থায় দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং পদ্মা সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলার নতুন এলাকাজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ঢাকা-যশোর-খুলনার মধ্যে ২১২ দশমিক ০৫ কিলোমিটার সংক্ষিপ্ত রুট এবং উন্নত পরিচালন সুবিধার বিকল্প রেলপথ সংযোগ স্থাপিত হবে।
এটি বাংলাদেশে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি সাব-রুট স্থাপন এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মালবাহী এবং বিজি কনটেইনার ট্রেন পরিসেবা চালু করবে। এই রুটটি কনটেইনার পরিবহনের ক্ষেত্রে গতি এবং লোড সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে।