আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিশ্ববাজারে চালের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনাম চালের রপ্তানি কমানোর পরিকল্পনা করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে চালের রপ্তানি অর্ধেক কমিয়ে ৪০ লাখ টনে আনবে বলে জানিয়েছে দেশটি। ভিয়েতনাম সরকারের চাল রপ্তানির কৌশল সংক্রান্ত বিস্তারিত এক নথির বরাত দিয়ে শনিবার এসব তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
এতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চালের বার্ষিক রপ্তানি কমিয়ে ৪০ লাখ টনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ভিয়েতনাম। গত বছর বিশ্ববাজারে ভিয়েতনামের চালের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭১ লাখ টন। ভারত ও থাইল্যান্ডের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনাম ।
ভিয়েতনামের চালের অন্যতম বড় আমদানিকারক বাংলাদেশও। গত বছরের আগস্টে ভিয়েতনাম থেকে জিটুজি পর্যায়ে ২ লাখ টন নন-বাসমতি ও ভারত থেকে ৩০ হাজার টন আতপ চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সরকার। নন-বাসমতি চাল প্রতি কেজি ক্রয় মূল্য ৪৯.৪৯ টাকা এবং আতপ চাল ৪৬.৯৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বিশ্বের একটি বিপুল অংশের জনগোষ্ঠীর প্রধান খাদ্য চাল। বিশ্বের মোট ৯০ ভাগ চাল উৎপাদন হয় ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশে। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন শস্যের দাম বাড়লেও এতদিন চালের বাজার স্থিতিশীল ছিল।
তার প্রধান কারণ গত দুই বছরের বাম্পার ফলন ও চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোর কাছে চালের বিশাল মজুত থাকা। তবে ভিয়েতনাম উৎপাদন ও রপ্তানি কমিয়ে ফেললে আগামী দিনে গম ও অন্যান্য শস্যের মতো এশিয়ার বাজারে চালের সরবরাহ-সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ভিয়েতনামের সরকারি ওই নথি পর্যালোচনা করে রয়টার্স বলছে, উচ্চমানের চালের রপ্তানি বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ভিয়েতনাম।
নথিতে বলা হয়েছে, চাল রপ্তানি থেকে ভিয়েতনামের বার্ষিক আয় আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ২৬২ কোটি ডলারে নেমে আসবে। গত বছর দেশটির এই আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৪৫ কোটি ডলার।
হো চি মিন সিটির একজন চাল ব্যবসায়ী শনিবার রয়টার্সকে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভিয়েতনামের ধান চাষের জমি কমে গেছে। কিছু কৃষক অন্যান্য ফসল ও চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। তারপরও সরকারের এই কৌশল অত্যন্ত আক্রমণাত্মক বলে মনে হচ্ছে।
এই ব্যবসায়ী বলেন, মেকং ডেল্টা অঞ্চলের কিছু ধান চাষি তাদের জমির কিছু অংশ ফলের খামারে পরিণত করছেন। তারা ধানের বদলে আম, জাম্বুরা, কাঁঠাল এবং ডুরিয়ান চাষ করছেন। তবে বেশিরভাগ কৃষক এখনও ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে মেকং ডেল্টা অঞ্চলে লবণাক্ততা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এসব কারণে গত কয়েক বছর ধরে ওই অঞ্চলে চিংড়ি চাষের প্রবণতা বাড়ছে।
দেশটির সরকারের নথিতে বলা হয়েছে, যেকোনও দেশের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাল রপ্তানিতে বৈচিত্র্যতা আনতে চায় ভিয়েতনাম। দীর্ঘদিন ধরে ভিয়েতনামের চালের অনত্যম বৃহৎ ক্রেতা ফিলিপাইন। গত বছর ভিয়েতনামের মোট চাল রপ্তানির প্রায় ৪৫ শতাংশই গেছে ফিলিপাইনে।
চলতি মাসে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক এক বৈঠকে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্দ মার্কোস জুনিয়রকে ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ফাম মিন চিন বলেন, ফিলিপাইনে যৌক্তিক মূল্যে দীর্ঘমেয়াদে চাল সরবরাহে ইচ্ছুক ফিলিপাইন।
নথিতে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ভিয়েতনামের চাল রপ্তানির ২২ শতাংশ আফ্রিকা, ৭ শতাংশ আমেরিকান, ৪ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যে এবং ৩ শতাংশ ইউরোপের বাজারে যাবে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে এশিয়ার বাজারে এই রপ্তানি ৫৫ শতাংশ এবং ইউরোপে মাত্র ৫ শতাংশ হবে।
সরকারি ওই নথি বলছে, ভিয়েতনাম যেসব দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেসব দেশের মধ্যে যাদের মানসম্মত শস্য ও উচ্চ চাহিদা রয়েছে, কেবল এমন বাজারেই চালের রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করবে। নথিতে বলা হয়েছে, ভিয়েতনাম ধানে কীটনাশকসহ অন্যান্য সুরক্ষা পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে আনার চেষ্টাও চালিয়ে যাবে।
ভিয়েতনামের চাল প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন ভিয়েতনাম ফুড অ্যাসোসিয়েশন এই বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
দেশটির সরকার বলছে, ভিয়েতনাম উচ্চ মানসম্পন্ন, সুগন্ধি ও আঠালো চাল উৎপাদনে মনোযোগ দেবে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটিতে নিম্নমানের চালের উৎপাদন ১৫ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনবে।
মেকং ডেল্টা প্রদেশের চাল ব্যবসায়ী আন গিয়াং বলেন, সরকারের এই কৌশলের বাস্তবায়ন নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। কারণ চালের উৎপাদন সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর নয়, বরং সরবরাহ ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে।
দেশটির সরকারি শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ভিয়েতনামের চাল রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে ২৯ লাখ টন হয়েছে।
সূত্র: রয়টার্স।