নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে ব্যবসা করা বেশ কয়েকটি জীবন বিমা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে নানা অনিয়মে জড়িয়ে। কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে, গ্রাহকের বিমা দাবি তারা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে প্রায় এক ডজন বিমা কোম্পানির ব্যবসা সাময়িক বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এরই মধ্যে একটি জীবন বিমা কোম্পানির ব্যবসা সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, বিমা খাতে ইতিবাচক ইমেজ ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের উচ্চ মহল থেকে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু কয়েকটি কোম্পানির অবস্থা এতটাই খারাপ যে, এগুলো ভালো করা সম্ভব নয়। কয়েক বছরের মধ্যে কোম্পানিগুলো অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়বে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানি সক্ষমতা না থাকায় গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। সার্বিক দিক বিবেচনায় কয়েকটি কোম্পানির ব্যবসা সাময়িক বন্ধের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, কয়েকটি কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ করার পরিকল্পনা আইডিআরএ’র নিজের নয়। গোয়েন্দা সংস্থা এবং সরকারের একটি মহল থেকেও এসব কোম্পানির ব্যবসা সাময়িক বন্ধের জন্য বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল হয়ে পড়া, বিনিয়োগে অনিয়ম করা, ব্যবস্থাপনা খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করা, গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধ করতে না পারা, লাইফ ফান্ডে টাকা না থাকা, মাত্রাতিরিক্ত কমিশন ব্যয়সহ যেসব কোম্পানিতে অতিরিক্ত আর্থিক অনিয়ম হয়েছে, সেসব কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ করা হতে পারে।
এদিকে আইডিআরএ’র তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ধারাবাহিকভাবে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের হার কমছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোতে ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৯৩০ গ্রাহকের বিমা দাবি উত্থাপন হয়। এর আর্থিক মূল্য ১৩ হাজার ৮২৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
উত্থাপন হওয়া এই দাবির বিপরীতে কোম্পানিগুলো ১৮ লাখ ৯২ হাজার ৯৯২টি দাবি পরিশোধ করেছে। যার আর্থিক মূল্য ৯ হাজার ২৫৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৩৮ গ্রাহকের ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা বিমা দাবি পরিশোধ করা হয়নি। এ হিসাবে ২০২২ সালে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের হার ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ গ্রাহক বিমা দাবির টাকা পাননি।
এর আগে ২০২১ সালে ২৪ লাখ ৬৮ হাজার ৪১০টি দাবি উত্থাপিত হয় এবং পরিশোধ করা হয় ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ৭৪৩টি। দাবি পরিশোধের হার ছিল ৭০ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০২০ সালে ১৯ লাখ ৭ হাজার ৫৫৯টি বিমা দাবি উত্থাপিত হয় এবং পরিশোধ করা হয় ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৯১৬টি। পরিশোধের হার ছিল ৮৪ দশমিক ৮২ শতাংশ।
তার আগে ২০১৯ সালে ২০ লাখ ৭৪ হাজার ৮১৬টি বিমা দাবি উত্থাপন হয় এবং পরিশোধ করা হয় ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ১৪৬টি বিমা দাবি। দাবি পরিশোধের হার ছিল ৮৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর ২০১৮ সালে ২৪ লাখ ২৬ হাজার ৬৩৭টি বিমা দাবি উত্থাপন হয় এবং পরিশোধ করা হয় ২১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৬টি। দাবি পরিশোধের হার ছিল ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
আইডিআরএ সূত্রে আরও জানা গেছে, জীবন বিমা কোম্পানিগুলো ২০২২ সালের যে প্রতিবেদন দিয়েছে তার তথ্য অনুযায়ী ২০টি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনসীমার ওপরে রয়েছে। এ কোম্পানিগুলো কমিশন, বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া ও নানাবিধ খাতের খরচ দেখিয়ে ব্যবস্থাপনা খাতে ১১৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছে।
এরমধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা করপোরেশন ৩১ কোটি ৮১ লাখ, গোল্ডেন লাইফ ১৫ কোটি, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ১৪ কোটি ৯৭ লাখ, প্রোগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৮ কোটি ৯৪ লাখ, যমুনা লাইফ ৬ কোটি ৩৮ লাখ, বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ৬ কোটি ৩৫ লাখ, পদ্মা ইসলামী লাইফ ৪ কোটি ২৯ লাখ, সানফ্লাওয়ার লাইফ ৩ কোটি ৬৭ লাখ, স্বদেশ ইসলামী লাইফ ৩ কোটি ৫৫ লাখ, প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ ৩ কোটি ৯ লাখ, এলআইসি বাংলাদেশ ২ কোটি ৬৬ লাখ, বায়রা লাইফ ২ কোটি ৬০ লাখ, আকিজ তাকাফুল লাইফ ২ কোটি ২ লাখ, ডায়মন্ড লাইফ ২ কোটি, জেনিথ ইসলামি লাইফ ১ কোটি ৯৩ লাখ, আস্থা লাইফ ১ কোটি ৮০ লাখ, বেস্ট লাইফ ১ কোটি ৩৩ লাখ, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ৪৯ লাখ, মার্কেন্টাইল ইসলামি লাইফ ৪৩ লাখ এবং সানলাইফ ২৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।
একটি জীবন বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বলেন, দেশে ব্যবসা করা সব বিমা কোম্পানি খারাপ নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন ধারণা জন্ম নিয়েছে, বিমা মানেই প্রতারণা। গুটিকয়েক কোম্পানির জন্য বিমা খাতের এ অবস্থা। যে কারণে দেশের বিমা খাত এগোতে পারছে না। এই বিমা কোম্পানিগুলো কোনো আইন মানছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। বিমা খাতের ইমেজ সংকট দূর করতে হলে শক্ত পদক্ষেপ নিতেই হবে। মনে রাখতে হবে, দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়াল ভালো। তাই অনিয়মে নিমজ্জিত কোম্পানিগুলো বহাল তবিয়তে না রেখে, এদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়াই উচিত।
তিনি বলেন, দেশের আর্থিক অবস্থার তুলনায় বিমা কোম্পানির সংখ্যা বেশি। তবে এরমধ্যেও কয়েকটি কোম্পানি খুব ভালো ব্যবসা করছে। তারা সব নিয়মকানুন মেনে চলছে। কিন্তু কিছু কোম্পানি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। একাধিক বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়লে ওই জীবন বিমা কোম্পানি গ্রাহকের দাবির টাকা দেবে কীভাবে? সে তো গ্রাহকের সব টাকা খেয়ে ফেলেছে। এ ধরনের কোম্পানির ব্যবসা অব্যাহত থাকলে বিমা খাতের জন্য খারাপ ছাড়া ভালো কিছু হবে না।
বিমা খাতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, গত বছর মোট ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা বিমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে। যেটা তার আগের বছর ছিল ৭ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। কিন্তু আমরা যদি আনুপাতিক হারে দেখি ২০২২ সালে মাত্র ৬৬ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ হয়েছে। অর্থাৎ একশটা পলিসির দাবি করা হলে ৬৬ শতাংশ নিষ্পত্তি করা হয়। আগের বছর এটা ছিল ৬৮ শতাংশ। তার আগের বছর ৮৭ শতাংশ এবং তার আগের বছর ৮৯ শতাংশ। মানে প্রতি বছর আমরা বিমা দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ প্রায় ৪০ ভাগের মতো মানুষ বিমা করে বিমার ন্যায্য দাবি পাচ্ছেন না। এটা বিমার ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।
তিনি বলেন, যে বিমা কোম্পানিগুলো দাবি পরিশোধ করতে পারছে না, তাদের বেশিরভাগ ইচ্ছা করে করছে না তা নয়। বেশিরভাগের সেই সক্ষমতাই নেই। তারা সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কারণ তারা অপচয় করেছে, ব্যবস্থাপনা ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত, দুইশ-তিনশ গুণ করেছে। লাইফ ফান্ডে টাকা রাখেনি। বিনিয়োগ করেছে অলাভজনক খাতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্দ বিনিয়োগ বা ইচ্ছাকৃতভাবে বিনিয়োগের নামে টাকা তছরুপ করেছে। এখন যখন তাদের বিমা দাবি পরিশোধের সময় এসেছে, তারা বিমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না। যাই বা করছে নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে, সেখান থেকে দাবি পরিশোধ করছে। এতে ভবিষ্যতের জন্য আরও দায় বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে অন্তত ১০টি বিমা কোম্পানির অস্তিত্ব দুই-চার বছরের মধ্যে মারাত্মক সংকটে পড়বে। প্রতিদিন আমাদের কাছে কয়েকশ দরখাস্ত আসে, বিমা দাবি পাচ্ছে না। আমাদের কাছে যারা আসছেন, তারা দীর্ঘদিন বিমা কোম্পানির মাঠ পর্যায়ের অফিস ঘুরে আসছেন। ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, এখন এসব মানুষ থানায় গিয়ে, কোর্টে গিয়ে মামলা করছে। উকিল নোটিশ দিচ্ছে।