বাগেরহাট প্রতিনিধি : জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে আজ থেকে সুন্দরবনে শুরু হচ্ছে নতুন পর্যটন মৌসুম। একই সঙ্গে সুন্দরবনের নদী ও খালে মাছ, কাঁকড়া ধরার অনুমতি পাচ্ছেন বনজীবীরা। সকাল থেকে ব্যস্ততা বেড়েছে সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলের জেলে ও সুন্দরবনের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ট্যুর অপারেটরদের।
শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে পশ্চিম সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট ক্যাম্প থেকে পাস (বনবিভাগের অনুমতিপত্র) নিয়ে সুন্দরবনের যেতে শুরু করেছেন বনজীবীরা।
বিশ্ব ঐতিহ্যর অংশ সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মাছের প্রজনন ও সংরক্ষণে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানিংয়ের (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে দুই বছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের সব নদী-খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকে। তবে ২০২১ সাল থেকে মৎস্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে এই সময় এক মাস বাড়িয়ে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করে বন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে বন্ধ রাখা হয় পর্যটক প্রবেশ। সেই নিয়ম অনুযায়ি গতকাল সেই নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। এজন্য আজ থেকে পুনরায় পর্যটকরা যেতে পারবেন বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে। আর বনের ওপর নির্ভরশীল জেলেরাও যাচ্ছেন তাদের জীবিকার অন্বেষণে।
সুন্দরবন সংলগ্ন বুড়িগোলিনী গ্রামের বনজীবী মাজেদ আলী বলেন, বনের ওপর আমাদের জীবন-জীবিকা। তবে গত তিন মাস খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্টে দিন পার করেছি। তিন মাস পর আজ মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করে আবারও বনে যাচ্ছি। যদি মাছ ধরে আনতে পারি তাহলে আগে মহাজনের টাকা শোধ করতে হবে। এছাড়া মাছের আড়ত থেকে দাদনে টাকা নিয়ে জাল কেনা। এজন্য তাদের কাছে এসব মাছ বিক্রি করতে হবে। দামটা তারাই নির্ধারণ করে দেয়। আমরা মাছের দাম কম পেলেও মানুষ অতিরিক্ত দামে মাছ কিনে খাচ্ছে।
একই এলাকার বাচ্চু গাজী বলেন, এবারও নিষেধাজ্ঞাকালে জেলেদের চাল সহায়তা দিয়েছে সরকার, কিন্তু যে পরিমাণ চাল সরকার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় তা দিয়ে তাদের পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন যায়। আবার অনেক নিবন্ধিত জেলেকার্ড থাকা সত্ত্বেও অনুদানের চাল পাইনি।
তিনি বলেন, মহজনের কাছ থেকে সুদের টাকা নিয়ে বনে যাচ্ছি। মাছ ধরার পাসের সময় অল্প হওয়ায় যে টাকা দিয়ে জাল-নৌকা ঠিক করেছি সেই টাকা উসুল করতে পারবো কি না জানি না।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের ট্যুরিস্ট ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি কে এম আনিছুর রহমান বলেন, গত তিন মাস অনেক পর্যটক সুন্দরবন ঘুরতে এলেও তারা বনে ঢুকতে পারেননি। তিন মাস ট্রলারগুলো ঘাটে বসে ছিল। এজন্য আর্থিকভাবে তাদের লোকশান হয়েছে। চলতি মৌসুম শুরুর আগে ট্রলারগুলো মেরামত ও রং করা হয়েছে। আজ থেকে আবার পর্যটক নিয়ে তারা সুন্দরবনের ভ্রমণ কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
তিনি বলেন, আগের চেয়ে বর্তমানে খরচ বেড়েছে এজন্য ট্রলারভাড়া আগের চেয়ে কিছুটা বাড়ানো হবে। এছাড়া তিন দিনের প্যাকেজ রেটে পরিতর্বন আনা হবে।
সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, আজ সকাল থেকে থেকে সুন্দরবনে জেলে ও পর্যটকদের জন্য পারমিট দেওয়া শুরু হয়েছে। টানা তিন মাস মাছ ধরা ও পর্যটক প্রবেশ বন্ধ থাকায় সুন্দরবনে মাছের পরিমাণ ও বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সমৃদ্ধ হয়েছে বনজসম্পদ।
তিনি বলেন, ট্যুর অপারেটর ও পর্যটকরা যেন সুন্দরবন কোনোভাবেই যাতে প্লাস্টিক জাতিয় পণ্য নিয়ে বনে প্রবেশ না করে সেটি লক্ষ্য রাখা হবে। বনকে সুরক্ষিত রেখেই পর্যটন ব্যবসায়ীদের ট্যুর অপারেট করার নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। এজন্য নির্ধারিত স্টেশনগুলোকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমে সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে। এজন্য বনের অভ্যন্তরে নতুন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার পাশাপাশি আগের স্পটগুলোও সংস্কার করে দর্শনার্থীদের ভ্রমণ উপযোগী করে তোলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে বাগেরহাটের দ্য সাউদার্ন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক পর্যটন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, শুক্রবার সকালে পর্যটক নিয়ে চারটি লঞ্চ সুন্দরবনে প্রবেশ করেছে। আর ট্রলার ও জালিবোটেও পর্যটক যাচ্ছে করমজলে। তবে তিন মাসে যে ক্ষতি হয়েছে আমাদের তা কোনোভাবেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মোংলা শাখা সভাপতি বিদ্যুৎ মন্ডল বলেন, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় আজ ভোর থেকেই বনবিভাগের পাস-পারমিট নিয়ে জেলেরা সাগর ও সুন্দরবনে মাছ শিকারে যেতে শুরু করেছেন। নিষেধাজ্ঞার সময় চরম মানবেতর জীবনযাপন করেছেন জেলেরা। এ সময় তারা নামমাত্র যে চাল পেয়েছিলেন তা ছিল চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, তিন মাসের নিষেধাজ্ঞায় বনের নদী-খালে মাছ ও বন্যপ্রাণীর প্রজনন বৃদ্ধি পেয়েছে, এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হয়েছে।