মূল্যস্ফীতি কমাতে বাড়ানো হলো সুদহার

নিউজ ডেস্ক : চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে এখন থেকে কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে গেলে শতকরা ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হবে। যা আগে ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে এখন থেকে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা আদায় করতে পারবে।

রোববার (২৬ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটারি পলিসি কমিটি বা এমপিসির প্রথম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের কনফারেন্স হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক ও পরিচালক সাঈদা খানম প্রমুখ।

বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয় সেটা ব্যাংক রেট। রিভার্স রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। রেপো রেট বাড়ানোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলোর অর্থ নেওয়ার খরচ বাড়বে।

ড. হাবিবুর রহমান জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প এখন দেখছি না। ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়লে আগের চেয়ে কম ঋণ গ্রহণ করবে মানুষ। পক্ষান্তরে যাদের কাছে টাকা রয়েছে বেশি মুনাফা পাওয়ার আশায় তারা ব্যাংকে টাকা রাখবে। এতে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে এবং আগামী বছরের জুনের মধ্যে ৬ শতাংশে নামাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজনে আবারও সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

এক প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাকের এই প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলাফল আসতে কিছুটা সময় লাগে। কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে বাধাগ্রস্ত করে বৈরী আবহাওয়া। আগেও আমরা বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিন্তু বর্ষাকাল হওয়ায় তখন ভালো ফল পাওয়া যায়নি। এখন যেহেতু আবহাওয়াজনিত কোনো সমস্যা নেই, তাই আশা করছি খুব দ্রুতই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের মূল লক্ষ্য নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই মূল লক্ষ্য। প্রয়োজনে জিডিপি কিছুটা কমবে। তারপরও সবার আগে মূল সমস্যায় নজর দিতে হবে। এরই মধ্যে আমরা ক্ষুদ্র এবং কৃষিঋণ বিতরণের গুরুত্ব বাড়িয়েছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরের তিনজন অর্থনীতিবিদ নিয়ে গঠিত নতুন মুদ্রানীতি কমিটির সিদ্ধান্তে নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া নীতি সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটির (এসডিএফ) সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমকি ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।

বর্তমানে ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ তথা– সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের ওপর ভিত্তি করে সুদহার নির্ধারিত হয়। প্রতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ হার জানিয়ে দেয়। এতোদিন ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে পরবর্তী মাসের ঋণের সুদহার নির্ধারণ হয়ে আসছিল। নতুন সিদ্ধান্তের কারণে এখন ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে অর্থাৎ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে।

গত অক্টোবর মাসে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদ (স্মার্ট রেট) ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে চলতি মাস নভেম্বর ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। সে হিসাবে ঋণের সুদ হবে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ। নভেম্বরে ঠিক করা ঋণের সুদহার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তন করা যাবে না।

এর আগে গত ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুল রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে পুনর্গঠিত মনিটারি পলিসি কমিটি (এমপিসি) এর প্রথম সভা হয়। সভায় কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে কাজী ছাইদুর রহমান, ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; ড. মো. হাবিবুর রহমান, প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক; ড. সাদিক আহমেদ, অর্থনীতিবিদ; ড. বিনায়ক সেন, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান; অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন, চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ড. মো. এজাজুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক অংশগ্রহণ করেন।

সভায় অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিকসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি, বিনিময় হার, তারল্য ও সুদহার পরিস্থিতি এবং নীতি সুদহারের গতিবিধি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। সভায় বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ এবং ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের সমস্যা মোকাবিলার বিষয়গুলো উঠে আসে।

দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি চলতি বছরের ডিসেম্বর শেষে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে ৮ শতাংশে এবং আগামী বছরের জুন শেষে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সভায়। গত অক্টোবর মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসারা দেশে ২৩০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
পরবর্তী নিবন্ধ১ বছরে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ৮ লাখ টন