নিউজ ডেস্ক : বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে লেনদেন না করার কথা জানিয়েছে তৈরি পোশাক খাতের একটি বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে অর্ডার দেওয়া পণ্য না নেওয়া কিংবা অর্থ পরিশোধ না করার শর্ত দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে। ফলে এ নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
বুধবার (৬ ডিসেম্বর) গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান এর ব্যাখ্যা দেন। তার বিবৃতি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
বিশ্ব বাণিজ্যের দৃশ্যপট দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানবাধিকার এবং পরিবেশগত ডিউ ডিলিজেন্স ক্রমবর্ধমানভাবে অগ্রাধিকার পাচ্ছে, অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলোও বাণিজ্যকে প্রভাবিত করছে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাণিজ্যের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, তাই বাণিজ্য নীতি সংক্রান্ত যে কোনো নতুন বিষয় আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। তাই, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করার জন্য আমি এই বিবৃত্তি দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছি।
সম্প্রতি বিজিএমইএ’র এক সদস্যকে বিদেশি ক্রেতার পাঠানো একটি লেটার অব ক্রেডিটে (এলসি) অনুলিপি আমাদের নজরে এসেছে। এলসিতে নিম্নলিখিত বিষয়টি রয়েছে-
‘আমরা জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত কোনো দেশ, অঞ্চল বা দলের সঙ্গে লেনদেন প্রক্রিয়া করবো না। নিষেধাজ্ঞার কারণগুলোর জন্য আমরা কোনো বিলম্ব, নন-পারফরমেন্স বা/ তথ্য প্রকাশের জন্য দায়ী নই।’
এই ধারাটির ব্যাখ্যায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে বলে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, যা সঠিক নয়।
এটি উল্লেখ্য যে এলসিটি একটি নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছ থেকে এসেছে এবং এটি কোনো দেশের দ্বারা সংবিধিবদ্ধ আদেশ বা বিজ্ঞপ্তি নয়। সুতরাং এটিকে বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রয়োগ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বার্তা হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করা উচিত হবে না।
এটিকে আরও স্পষ্ট করে বলছি যে স্বতন্ত্র ক্রেতা/প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নীতি এবং প্রোটোকল থাকতে পারে, তবে একটি এলসি কপি বা একটি ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক ইনস্ট্রুমেন্ট কোনো অফিসিয়াল ঘোষণা নয়। এছাড়া, বিজিএমইএ আমাদের কূটনৈতিক মিশন থেকে বা কোনো অফিসিয়াল সোর্স থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বা বাণিজ্য ব্যবস্থা আরোপের তথ্য পায়নি।
শ্রমিকদের অধিকার এবং কল্যাণকে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে একটি শ্রম রোডম্যাপ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালে শ্রম আইনের সংশোধনসহ এটি বাস্তবায়নের জন্য সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রম বিধিগুলো ২০১৫ সালে জারি করা হয়েছিল এবং ২০২২ সালে সংশোধন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯ সালে পাস করা হয় এবং ২০২২ সালে ইপিজেড শ্রম বিধি জারি হয়।
একটি কারখানার ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য ৩০ শতাংশ শ্রমিকদের অংশগ্রহণের পূর্ববর্তী শর্ত (থ্রেশহোল্ড) শিথিল করে ২০ শতাংশ করা হয়েছিল। যা কি না বাংলাদেশের শ্রম আইনের (বিএলএ) সাম্প্রতিক সংশোধনীতে আরও হ্রাস করে ৩০০০ এরও বেশি শ্রমিক নিয়োগকারী কারখানাগুলোর জন্য ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। গ্রুপ অব কোম্পানিজের জন্য থ্রেশহোল্ড ৩০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য কেন্দ্রীয় তহবিলে অবদান রাখা আইনত বিধান করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই তহবিলে শিল্প প্রায় ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান রয়েছে। জিআইজেড এবং আইএলও এর সহযোগিতায় এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম (ইআইএস) এখন পোশাকশিল্পে পাইলটিং করা হচ্ছে, যার নজির বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। নির্বাচিত শ্রমিকদের অংশগ্রহণ কমিটি এবং নিরাপত্তা কমিটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বিশ্বের সেরা পারফর্মিং বেটার ওয়ার্ক কারখানাগুলোর মধ্যে কয়েকটি বাংলাদেশে রয়েছে। আইএলও এর সঙ্গে আমরা ‘প্রমোটিং সোশ্যাল ডায়ালগ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন ইন দি বাংলাদেশ আরএমজি সেক্টর (এসডিআইআর)’ শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা করেছি। কারখানায় বিদ্যমান কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করতে, বিশেষ করে অংশগ্রহণ কমিটি, নিরাপত্তা কমিটি এবং হয়রানি বিরোধী কমিটি শক্তিশালী করার জন্য বিজিএমইএ জিআইজেড এর সহযোগিতায় পাইলটিং ভিত্তিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি কারখানাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ব্র্যান্ড, রিটেইলার, উন্নয়ন অংশীদার এবং কারখানা কর্তৃক শিল্প সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বিজিএমইএ ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় হার প্রকল্প (HER project), মাদারস ওয়ার্ক প্রকল্পের মাধ্যমে মাতৃত্ব সুরক্ষা, মনের বন্ধুর মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সুস্থতা পরিষেবাসহ আরও অনেক কর্মসূচি চালু রয়েছে। উৎপাদন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, দায়িত্বশীল করার জন্য আরও অনেক উদ্যোগ বিবেচনাধীন। এই সব উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে শ্রমিকদের অধিকারগুলো সমুন্নত রাখা এবং শ্রমিকদের কল্যাণ বৃদ্ধি করা।
২০১৩ সালে মর্মান্তিক ভবন ধসের দুর্ঘটনার পর, শিল্পটি জাতীয় উদ্যোগের নেতৃত্বে একটি বড় নিরাপত্তা সংস্কারের মধ্যদিয়ে গেছে এবং ক্রেতাদের চালিত প্রোগ্রাম, অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ, অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে সংস্কার হয়েছে। নিরাপত্তা সংস্কার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করতে একটি কারখানা গড়ে প্রায় ৫ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে, যা কারখানাটি রিট্রোফিট অথবা স্থানান্তর করার তুলনায় ৪-৬ গুণ বেশি ছিল। এই উদ্যোগগুলোর দ্বারা গৃহীত অগ্রগতিগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং জাতীয় পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠার জন্য আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি) ২০২০ সালের জুনে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পখাতের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাগুলোকে একটি ছত্রছায়ায় নিয়ে আসে।
শ্রমিকদের আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে ২০১০ সাল থেকে ন্যূনতম মজুরি ছয় গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মজুরির ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট এবং ২টি উৎসব ভাতা (প্রতিটি এক মাসের মূল মজুরির সমতুল্য) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শ্রমিকদের চিকিৎসা ছুটি এখন অর্ধেক মজুরির পরিবর্তে ১৪ দিনের জন্য পূর্ণ মজুরিতে দেওয়া হচ্ছে। বার্ষিক ছুটির বিধান সংশোধন করা হয়েছে। এটি প্রতি ১৮ দিনের কাজের জন্য এক করা হয়েছে, যা আগে প্রতি ২২ দিনের জন্য একদিন করা ছিল। শ্রমিকরা আইন অনুসারে তাদের মোট বার্ষিক ছুটির ৫০ শতাংশ নগদায়ন করতে পারে, যা আগে আইনে ছিল না।
সবুজ রূপান্তরের ক্ষেত্রেও আমরা এগিয়ে আছি। বাংলাদেশ এখন ২০৪টি লিড প্রত্যয়িত পরিবেশবান্ধব কারখানার আবাসস্থল, যার মধ্যে ৭৪টি প্লাটিনাম রেটেড এবং ১১৬টি গোল্ড রেটেড। আরও ৫০০ কারখানা সার্টিফিকেশনের জন্য প্রক্রিয়াধীনে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০০টি সর্বোচ্চ মানের লিড পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশে রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০টির মধ্যে ৯টি এবং বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ২০টি লিড প্রত্যয়িত কারখানার মধ্যে ১৮টি বাংলাদেশে রয়েছে। এবং এটি সত্যিই গর্বের বিষয় যে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্কোরিং কারখানাটি ১০৪ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশে।
আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের অনেক রপ্তানি বাজারের জন্য মানবাধিকার এবং পরিবেশগত পরিবেশগত ডিউ ডিলিজেন্স ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার আমাদের বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর ইউএস প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরান্ডাম ‘কর্মীর ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং বিশ্বব্যাপী চলমান লেবার ক্যাম্পেইনের সঙ্গে উচ্চ শ্রমমান জুড়ে দিয়ে স্বাক্ষর করেছে, যা এনগেজমেন্ট এবং প্রয়োগের দিক থেকে বেশ স্বতন্ত্র বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। আমরা এর তাৎপর্যকে সম্মান করি এবং এর মূল নীতিগুলোর সঙ্গে একাত্মতা খুঁজে পাই। যদিও স্মারকলিপিতে কূটনৈতিক ও সহায়তার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা এবং যথাযথ আর্থিক নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য জরিমানা, ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য পদক্ষেপসহ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। তবে এটি বাংলাদেশের জন্য গৃহীত নয়। বরং এটি শ্রমিক অধিকার ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা অবস্থান।
আমরা অতীতেও একই ধরনের উদাহরণ দেখেছি। এক ক্রেতার কাছ থেকে আসা একটি এলসি ক্লজ উদ্ধৃত করে এটিকে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা হিসেবে সাধারণীকরণ করা হয়েছে। এ ধরনের ভুল তথ্য উপস্থাপনের বিরুদ্ধে সব সময়ই আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি। তবে, আমরা বাণিজ্যিক কাগজপত্র ও উপকরণে এ ধরনের ধারা অন্তর্ভুক্ত করাকে সমর্থন করি না, যদি এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনুশীলন করা হয়। বিজিএমইএ তার সদস্যদের, যারা ওপরে উল্লিখিত এ জাতীয় ধারাসহ এলসি গ্রহণ করে, তাদের সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে এর একটি স্পষ্টীকরণ চাওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। যদি ধারাটি কেবলমাত্র বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের অনুকূলে জারি করা এলসিগুলোতে থাকে, তবে এটি নৈতিকতা লঙ্ঘন করে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে, আমরা আমাদের সদস্য কারখানাগুলোকে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার জন্য এবং প্রয়োজনে এ ধরনের ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা/পুনর্বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করবো।