নিউজ ডেস্ক : শুধুমাত্র সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেছেন, চাহিদাজনিত কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বড় ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সরবরাহের ঘাটতি থেকে। এ অবস্থায় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো গেলই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) আয়োজনে এক গোল টেবিল বৈঠকে বৃহস্পতিবার তিনি এই মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে বিদেশি ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিত সুফল আসবে এমন প্রকল্প চিহ্ণিত করার পাশাপাশি ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করারও তাগিদ দেন সালেহউদ্দিন।
রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে অনুষ্ঠিত গোল টেবিলে “বাংলাদেশ’স এক্সটারনাল পাবলিক বোরোইংস অ্যান্ড ডেবিট সার্ভিসিং ক্যাপাসিটি আর দেয়ার রিজনস ফর কনসার্ন?’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান।
আলোচনায় সালেহউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের ঋণ সহায়তার অংশ হিসেবে আরোপ করা শর্তগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি শর্ত উল্টো মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, “আইএমএফ ফ্লেক্সেবল বিনিময় হার, সুদের হার বাড়ানো আর সংকোচনমূলক মূদ্রানীতির কথা বলে থাকে। এই পলিসি পরিপালন করে প্রায় ৫০ বছরে আর্জেন্টিনায় কোন উন্নতি হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে। বাড়তি চাহিদার কারণে মূল্যস্ফীতি হলে এই পলিসি কাজে লাগতে পারত। বাস্তবতা হচ্ছে এখানে সরবরাহে সঙ্কট থাকায় ম্যূলস্ফীতি হচ্ছে।
”সাপ্লাই বাড়ান, উৎপাদন বাড়ান, পণ্য বাড়ান, ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দেন, এতেই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে,” বলেন সালেহউদ্দিন।
প্রায় ৪০ টি দেশের স্টাডির ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি বলেছেন, সিএমএসএমই খাতে এমনিতেই ব্যাংক ঋণ দিতে চায় না। সংকোচনমূলক মূদ্রানীতি হলে এই খাতে ঋণ আরও কমবে। এর ফলে উৎপাদন কমে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে।
মূদ্রার বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি বিশ্বজুড়ে ইতিবাচকভাবে দেখা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়ে সজাগ থাকার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, ডলারের বিনিময় হার বাড়লে আসদানি কমে রফতানি বাড়বে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। তবে এর সঙ্গে রফতানির সক্ষমতাও বাড়তে হবে। ডলারের দাম ১৮০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও রফতানি দ্রুত বাড়বে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
টাকার অবমূল্যায়ন সব সময় সুফল নাও আনতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা বাড়তি ব্যয় ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেন। এর ফলে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বিাড়িয়ে দেয়। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়।
নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ভূল আর সংস্কারের অভাবে এমনটা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ডেট ট্র্যাপসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে ভঙ্গুর অবস্থা বলা হয়ে থাকে, এগুলো হলো ফলাফল। বাস্তবতা হলো এর কারণ নিয়ে কেউ কথা বলেন না।
টাকার মান ৮০-৮১ টাকায় ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এই অবস্থাপনার কারণে এক সাথে টাকার মান ৩০ শতাংশের বেশি পতন হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের রিফর্ম উল্টো পথে চলে গেছে। রাজস্ব বোর্ডের রিফর্ম. রেভিনিও জেনারেশনে রিফর্ম ও ব্যাংকিং সেক্টরে রিফর্মও নিশ্চিত করতে হবে।
বিদেশি ঋণের সঠিক ব্যবহারের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের নিজস্ব বিচার বিবেচনায় প্রকল্প নিতে হবে। সেই প্রকল্পগুলো আমাদের কাজে লাগবে কি না তা দেখতে হবে। আবার প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা আছে কি না তাও দেখতে হবে।”
যে কোন ঋণ বিশেষ করে বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে ইউটিলাইজেশানের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
বলেন, প্রকল্প সহায়তা যতটা কাজে লাগে, তার চেয়ে বেশি কাজে লাগে বাজেট সাপোর্ট। অনেক সময় রোগী নেই এমন হাসপাতালের জন্য বিদেশি ঋণে বড় ভবন তৈরি হয়ে থাকে।
কম সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে আসছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কমার্শিয়াল ঋণের রিস্ক প্রিমিয়াম অনেক বেশি। দুর্নীতি আর ওয়েস্টেজের কারণে এমনটা হচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ফাইন্যান্সিয়াল একাউন্টে স্টেবিলিটি আনতে তিনি বিদেশি মূদ্রার ইনফ্লু বাড়াতে রফতানি ও রেমিট্যান্সে গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দেন। এ বিষয়ে বলেন, এক টাকা দুই টাকা বোনাস দিয়ে হবে না। বিদেশে অনেক এজেন্ট আছে যারা রেমিট্যান্স আদায় করে দেশে ডলার পাঠায় না। দেশের মধ্য থেকেই স্বজনদের কাছে টাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়।
তিনি এফডিআই বাড়াতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নতিরও তাগিদ দেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান অনুষ্ঠানে বলেন, শ্রীলংকা স্বল্প মেয়াদি ঋণের ফাঁদে পড়েছিল, বাংলাদেশেও এমন ঋণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, দেশের মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বিদেশি ঋণে করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি ব্যয় হচ্ছে।
রেহমান সোবহান বলেন, শ্রীলংকা স্বল্পকালীন ঋণের ফাঁদে পড়েছিল রফতানি কমে আসায়। আফ্রিকার কিছু দেশেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ তেমন অবস্থানে নেই। কিন্তু দেশে স্বল্প মেয়াদি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, বলেন তিনি।