নিউজ ডেস্ক : হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় কয়েকটি জেলায় তাণ্ডবলীলা চালিয়ে গেল। এ সময় বজ্রপাত, গাছচাপায় অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। ঝড়ে শত শত ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপড়ে গেছে হাজার হাজার গাছ। অনেক জায়গা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যাদের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে তারা এখন খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন সূত্র ভোলায় তিনজন, পিরোজপুরে দুজন, ঝালকঠিতে চারজন, পটুয়াখালীর বাউফলে দুজন, খুলনার ডুমুরিয়ায় একজন ও নেত্রকোনার খালিয়াজুরীতে একজন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে। এর মধ্যে নয়জনই নিহত হয়েছেন বজ্রপাতে। রোববার সকাল থেকে দুপুরে মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সময় জেলাগুলোতে কালবৈশাখী বয়ে যায়। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ভোলা, লালমোহন ও মনপুরা : ঝড়ে ভোলার তিন উপজেলার দুই শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। নিহত হয়েছেন এক শিক্ষকসহ তিনজন। এর মধ্যে লালমোহন উপজেলায় দুজন ও তজুমদ্দিনে একজন। নিহতরা হলেন-লালমোহন উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নে হারিস উদ্দিন (৬০), চরভূতা ইউনিয়নের মো. বাচ্চু মিয়া (২৮) এবং তজুমদ্দিন উপজেলার পূর্ব গোলকপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনজুরুল আলম মঞ্জু মাস্টার (৫৩)। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঝড় তাণ্ডব চালায়। ঝড়ের প্রভাবে সদর উপজেলায় ব্যাপক বৃষ্টি হয়।
লালমোহন উপজেলা নির্বাহী অফিসার তৌহিদুল ইসলাম জানান, ঝড়ে এই উপজেলার ফরাশগঞ্জ, বদরপুর, চরভূতাসহ কয়েকটি ইউনিয়নে গাছপালা ভেঙে পড়ে। এ সময় ফরাশগঞ্জ এলাকার হারিস উদ্দিন বদরপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে ছিলেন। ঝড় শুরু হলে তিনি একটি ঘরে আশ্রয় নেন। ঠিক ওই সময় ঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়লে তিনি মারা যান তিনি।
এছাড়া তজুমদ্দিন উপজেলায় ব্যাপক গাছপালা ভেঙে পড়ে। এ সময় দৌড়ে বাড়ি ফেরার সময় বজ্রপাতে আতঙ্কিত হয়ে মারা যান পূর্ব গোলকপুর সরকারি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনজুর আলম (মঞ্জু মাস্টার)। এদিকে ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে পুরো মনপুরা দ্বীপাঞ্চল। এই উপজেলার দাসেরহাট, ফয়েজউদ্দিন, সোনাপুর, হাজিরহাট, উত্তর সাকুচিয়া ও দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের তিন শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। হাজিরহাট ইউনিয়নের তিনটি গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কয়েকটি দোকান ঘর দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। ঝড়ে এই উপজেলায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। ঝড়ে শেষ সম্বল হারিয়ে দিশেহারা এই দ্বীপাঞ্চলের মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে রয়েছে।
পিরোজপুর : হঠাৎ ১৫ মিনিটের কালবৈশাখী ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে পিরোজপুর পৌরসভা, পালপাড়া ও ও সদর উপজেলার শারিকতলা ডুমরিতলাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম। সদর উপজেলার শারিকতলা ইউপির চেয়ারম্যান আজমীর মাঝি জানান, ঝড়ের কবলে পড়ে নলবুনিয়া গ্রামের খালে পড়ে অনিল পাল (৮২) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। অনিল পাল গ্রামের একটি বাজারে ছিলেন। ঝড় শুরু হলে তিনি দৌড়ে বাড়িতে রওয়ানা দেন। পথে প্রচণ্ড বাতাসে খালে পড়ে নিখোঁজ হন তিন। ঝড় থামলে স্থানীয়রা তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন।
এ ছাড়া শারিকতলা ইউনিয়নের মরিচাল গ্রামে ঘরের ওপর গাছ পড়ে রুবী বেগম (২২) নামে এক নারী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে তার শিশু কন্যা। শিশুটিকে চিকিৎসার জন্য খুলনা পাঠানো হয়েছে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
স্থানীয়রা জানান, সকাল পৌনে ১০টার দিকে হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো এলাকা। মুহূর্তেই শুরু হয় প্রায় দমকা হাওয়া, বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়। প্রায় ১৫ মিনিটের এ ঘূর্ণিঝড়ে পিরোজপুর পৌরসভা ও সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় শত শত গাছ উপড়ে পড়েছে। অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘরে টিনের চালা উড়ে দূরে গিয়ে পড়ে। এতে বন্ধ হয়ে যায় সড়ক যোগাযোগ। গাছ উপড়ে পড়ায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ।
ঝালকাঠি : ঝালকাঠিতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে রাতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এরপরই শুরু তীব্র ঝড় ও বৃষ্টি। এ সময় বজ্রপাতে শিশুসহ ৪ জন নিহত হয়েছে। তারা হলেনÑকাঁঠালিয়া উপজেলার উত্তর তালগাছিয়া গ্রামের গৃহবধূ হেলেনা বেগম (৪০), ঝালকাঠি সদর উপজেলার শেখের হাট ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের গৃহবধূ মিনারা বেগম (৩৫), পোনাবালিয়া ইউনিয়নের ইছালিয়া গ্রামের অটোচালক বাচ্চু হাওলাদারের ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ঈশান (১১) এবং রাজাপুর উপজেলার বড়ইয়া ইউনিয়নের রুহুল আমিন (৫৫)।
ঝালকাঠির পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরুজুল হক টুটুল জানান, চারজনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা জানান, মাঠে গরু আনতে গিয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়। আর রাজাপুরের রুহুল আমিন নদীতে মাছ ধরছিলেন।
জানা যায়, ঝড়ে রাজাপুর উপজেলার বলাইবাড়ি, সত্য নগর ও কৈবর্তখালি, পুটিয়াখালি, গাজিরহাট, চল্লিশকাহনি, বদনিকাঠিসহ বিভিন্ন স্থানে অর্ধশত বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। গাছপালা উপড়ে পড়ায় এসব এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
বাউফল (পটুয়াখালী) : পটুয়াখালীর বাউফলে কালবৈশাখী ঝড়ে রাতুল (১৪) নামের এক কিশোর ও সুফিয়া বেগম (৮৫) নামে এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছেন। রাতুল উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের রায় তাঁতেরকাঠি গ্রামের জহির সিকদারের ছেলে। তাকে রাস্তায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়েছে। আর সুফিয়া বেগমের বাড়ি উপজেলার দাশপাড়া ইউনিয়েনর চরআলগী গ্রামে। ঘরের ওপর গাছ চাপা পড়ে তিনি নিহত হন। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টা ৫ মিনিট-এই ৩৫ মিনিটের উপজেলার ঝড়ে কয়েকশ কাঁচা বাড়িঘর এবং কয়েক হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে।
ঝড়ে উপজেলায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যাওয়া এবং বেশ কয়েকটি খুঁটি ভেঙে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে তরমুজসহ রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বশির গাজী বলেন, ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কৃষি বিভাগ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাগেরহাট : সকাল ৯টার দিকে আকস্মিক ঝড়ে বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন স্থানে কয়েকশ কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। হাজার-হাজার গাছপালা উপড়ে ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। অকস্মিক ঝড় চলাকালে জেলার কচুয়া উপজেলার চর সোনাকুড় গ্রামে বজ্রপাতে লিকসান সরদার (৩২) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসার দপ্তরি ছিলেন। এছাড়া জেলা কেন্দ্রীয় বাস-টার্মিনালে একটি সাইনবোর্ডের টাওয়ার ভেঙে একটি যাত্রীবাহী বাসের ওপর পড়লে এক বাস শ্রমিক আহত হন। ঝড়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৫ জন আহত হয়েছেন। ঝড়ে সব থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বাগেরহাট সদর উপজেলার গোবরদিয়া, বাদেকাড়াপাড়া, ডেমা, খারদার, বাসাবাটি গ্রামসহ পৌর এলাকা। ঝড়ের শুরুতে সকালে জেলাজুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে বজ্রবৃষ্টি হলেও দিনের বেলায় এমন অন্ধকার আগে দেখেনি কেউ। প্রায় ২০ মিনিট অন্ধকারে ঢাকা থাকায় বন্ধ হয়ে যায় মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম। এরপর বজ্রপাতের সঙ্গে অবিরাম বৃষ্টিপাত শুরু হলে আকাশ পরিষ্কার হতে থাকে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালিদ হোসেন জানান, ঝড়ের মধ্যে গরু আনতে গিয়ে বজ্রপাতে মাদ্রাসার দপ্তরি লিকসান সরদার নিহত হন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারি ভাবে ৩ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এদিকে ঝড়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ে জেলা সদরসহ ৯টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বিকালে জেলা সদরের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ এলেও অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
ডুমুরিয়া (খুলনা) : খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়নের কোমলপুর গ্রামের ওবায়দুল্লাহ গাজী (৩০) রোববার ৮টার দিকে বাড়ির পাশের বিলে গরুর জন্যে ঘাস কাটতে যান। এ সময় আকস্মিক বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে তার পরিবারের লোকজন এবং এলাকাবাসী তার লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে আনেন। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
খালিয়াজুরী (নেত্রকোনা) : খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়নে রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় বজ্রপাতে মো. শহিদ মিয়া (৫২) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি ওই ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সকাল সাড়ে ১০টায় দিকে শহিদ মিয়া হাওরে মরিচ তুলতে যান। এ সময় হঠাৎ বৃষ্টি ও বাতাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই শহিদ মিয়া মারা যান। তিনি স্ত্রী, ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে গেছেন।
বেগমগঞ্জ (নোয়াখালী) : নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় কালবৈশাখী ঝড়ে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি ও কাঁচা গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে জেলার বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ তীব্র বাতাস ও বজ্রপাতসহ বৃষ্টি শুরু হয়। এ সময় হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়নের মানিক বাজারের সোনাদিয়া মডেল নুরানি মাদ্রাসার টিনশেড একটি ঘর উড়ে যায়। এছাড়া হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের একটি টিনশেড ভবন বিধ্বস্ত হয়। ঝড়ে জেলার বেশকিছু এলাকায় কাঁচা ঘর ও গাছপালা ভেঙে পড়ে।