নিউজ ডেস্ক : দীর্ঘ ১২ বছর পর জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বেঙ্গল ফাইন সিরামিকস লিমিটেড। কোম্পানিটিতে রক্ষক হিসেবে এসেছিলেন বহুল আলোচিত, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত পিকে হালদারের ঘনিষ্ট সহযোগি বিশ্বজিৎ কুমার রায়। কিন্তু কোম্পানিটিকে রক্ষা করার পরিবর্তে তিনি নিজেই ভক্ষক হয়ে উঠেছিলেন। প্রায় এক যুগ ধরে তিনি কোম্পানির মূল উদ্যোক্তা পরিচালকদের কোম্পানি থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত করে সবকিছু নিজের কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। বিশ্বজিৎ কুমার রায় যে সব শর্তে কোম্পানিটির মালিকানায় যুক্ত হয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিলো কোম্পানির সকল দায়-দেনা মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু গত ১২ বছরেও তিনি সেটা করেননি, যা শর্তের খেলাপ। বর্তমানে কোম্পানিটির মোট দায় ৯৫ কোটি টাকারও বেশি দাঁড়িয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অগোচরে কারখানার উৎপাদন ও বিপনন চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সংক্রান্ত কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বিএসইসি বা স্টক এক্সচেঞ্জকে দেননি। গত ১২ বছরে কোনো বোর্ড সভাও করেননি, কোনো ধরনের অডিটও করেননি, যা তালিকাভুক্তি নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পিকে হালদারের সহযোগিতায় বিশ্বজিৎ কুমার রায় বেঙ্গল ফাইন সিরামিকস কোম্পানিটি দখলের পাঁয়তারা করেছিলেন। বিশ্বজিৎ কুমার রায় পিপলস লিজিং এন্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের পেছনে সব রসদ যুগিয়েছেন পিকে হালদার। আর তার প্রধান সহযোগি হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্বজিৎ কুমার রায়। ২০০৭ সাল থেকেই আর্থিক সঙ্কটে ধুকতে থাকে বেঙ্গল ফাইন সিরামিকস কোম্পানিটি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোম্পানিটি দখলের ষড়যন্ত্র করেন পিকে হালদার ও বিশ্বজিৎ কুমার রায়। সেই অনুযায়ী তারা কোম্পানির সমস্ত দায় পরিশোধের শর্তে মালিকানায় যুক্ত হন। কিন্তু যুক্ত হওয়ার পর থেকেই তাদের চেহারা পাল্টে যায়। মূল মালিকদের জোর করে কোম্পানি থেকে বের করে দেন বিশ্বজিৎ কুমার রায়।
সেইসঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা দায়ও পরিশোধ না করায় কোম্পানির মূল উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। বিশ্বজিৎ কুমার রায়ের ক্ষমতার দাপটের কারণে কোম্পানির মূল উদ্যোক্তা ও সাবেক চেয়ারম্যান রাশেদ মাক্সুদ খানকে জেলও খাটতে হয়েছে। বিশ্বজিতের অত্যাচার সইতে না পেরে মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়ে সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন। এ অবস্থায় সাবেক চেয়ারম্যান রাশেদ মাক্সুদ খানের মেয়ে ফারজানা রুবাইয়াৎ খান, যিনি কোম্পানিটির একজন উদ্যোক্তা পরিচালক, তিনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসিতে অভিযোগ দেন। সেইসঙ্গে কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের আবেদন করলে বিএসইসি তার আবেদন মঞ্জুর করে।
এ বিষয়ে ফারজানা রুবাইয়াৎ খান বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন করে। এর আগে পুনর্গঠিত বোর্ডের স্বতন্ত্র পরিচালকগন ও বিশ্বজিত কুমার রায় গংদের সব দায় দেনা পরিশোধ করার জন্য তিন মাস সময় বেঁধে দেন এবং বারবার উদ্যোক্তা পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু বিশ্বজিত কুমার রায় গংরা সেই বেঁধে দেয়া সময়েও কোনো দায় দেনা পরিশোধ করেনি। উপরন্তু চূড়ান্ত অসহযোগিতা করেছেন এবং উদ্যোক্তা পরিচালকগনদের নানাবিধ ভয় ভীতি প্রদর্শন করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের বোর্ডও পদত্যাগ করে।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সহযোগিতায় আমরা উদ্যোক্তা পরিচালকগন নতুন করে ক্রেতা খুজতে থাকি এবং পেয়েও যাই। মৃত্যুর আগে উদ্যোক্তা পরিচালক ও চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ মাক্সুদ খান নতুন ক্রেতার সঙ্গে সব দায় দেনা পরিশোধের শর্তে নতুন করে চুক্তিতে উপনীত হন। চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছে শেয়ার হস্তান্তরের আবেদন করলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বরে আমাদের শেয়ার হস্তান্তরের আবেদন অনুমোদন করেন। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আমরা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াতে আছি। কিন্তু পূর্বের ন্যায় বিশ্বজিত কুমার রায় গংরা আমাদের নানা উপায়ে হুমকি দিচ্ছে, যা আমাদের প্রাণ সংশয়ের উদ্রেক করছে। উল্লেখ্য যে, সর্বশেষ হিসাব বিবরণী অনুযায়ী, বিশ্বজিৎ কুমার রায় কোম্পানিটি দখল করার সময় কারখানায় ১১ কোটি টাকারও বেশি বিক্রয়যোগ্য সিরামিক্স পণ্য এবং আনুমানিক ১.৬৪ কোটি টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ ও আনুষাঙ্গিক মালামাল ছিলো।
বিশ্বজিৎ কুমার রায় গণমাধ্যমকে বলেন, ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। ২০১২ সালে তিনি শেয়ার কিনেছেন। তবে, বিভিন্ন জটিলতার কারণে এখনো তার বেনিফিশিয়ারি ওনার (বিও) অ্যাকাউন্টে শেয়ারগুলো হস্তান্তর করা হয়নি। সম্প্রতি বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্সের প্রতিষ্ঠাতারা তাদের শেয়ার অপর কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছেন। এ বিষয়ে বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মূল মালিকদের কাছ থেকে বিশ্বজিৎ শেয়ার কিনলেও ওই শেয়ারের মালিকানা পরিবর্তন হয়নি। ফলে মূল উদ্যোক্তাদের একজন নতুন উদ্যোক্তার কাছে শেয়ার বিক্রির আবেদন জানালে কমিশন অনুমতি দিয়েছে।
আরো পড়ুন: বাজেট ঘোষণার আগে আইএমএফের ঋণ পাচ্ছে না বাংলাদেশ
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে উদ্যোক্তা পরিচালক ফারজানা রুবাইয়াৎ খান বলেন, ২০১২ সালে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে বিশ্বজিত কুমার রায়ের সঙ্গে কোম্পানির সব দায় দেনা পরিশোধের শর্তে উদ্যোক্তা পরিচালকগনের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় এবং বিশ্বজিত কুমার রায় কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মালিকানা হস্তান্তরের জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু উদ্যোক্তা পরিচালকগন বিশ্বজিত কুমার রায়ের কাছে শেয়ার হস্তান্তরের কোনো আবেদন করেননি। এরই ধারাবাহিকতায় যোগাযোগ ও কোম্পানির অধিগ্রহণের সুবিধার কথা উল্লেখ করে বিশ্বজিত কুমার রায় নিজেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঘোষণা করার জন্য অনুরোধ করলে উদ্যোক্তা পরিচালকগণ সরল বিশ্বাসে তাতে সম্মতি প্রদান করেন ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
ফলে ২০১২ সালে কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) উদ্যোক্তা পরিচালকগন বিশ্বজিত কুমার রায়কে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঘোষণা করেন এবং অংশীজনদের (ব্যাংক, আইসিবি, বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই ইত্যাদি) অবহিত করেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঘোষণা করার পরই বিশ্বজিত কুমার রায় গংরা পরিচালনার কথা বলে কারখানাটি দখলে নেন। পরবর্তীতে বিশ্বজিত কুমার রায় এবং উদ্যোক্তা পরিচালকগনের সাথে অগ্রনী ব্যাংক লিমিটেডের আলোচনার পর অগ্রনী ব্যাংক এক্সিট পলিসির আওতায় সম্পূর্ণ দায় ৩০ কোটি টাকা পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে এককালীন পরিশোধের সুযোগ দেয়। যা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বজিত কুমার রায় পরিশোধ করার জন্য উদ্যোক্তা পরিচালকগনদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন।
কিন্তু ২০১২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে সব দায় এককালীন পরিশোধের পরিবর্তে তিনি অগ্রনী ব্যাংকে সামান্য টাকা পরিশোধ করেন এবং আইসিবিসহ অন্যান্য দায় আর পরিশোধ না করে জোরপূর্বক কারখানা দখলে রেখে গ্যাস সংযোগ পুনরায় স্থাপন করে এখন পর্যন্ত উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সেইসঙ্গে উদ্যোক্তা পরিচালকগনকে না জানিয়ে অন্য ব্যাংকে হিসাব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কোম্পানির সুপারভাইজার মো. সাফায়েত হোসেন বলেন, বিশ্বজিৎ কুমার রায় অবৈধভাবে কোম্পানিটি দখল করে রেখেছিলেন। তিনি কর্মচারীদের বেতনও ঠিকমতো দেননি। অবশেষে বিএসইসির সহযোগিতায় মূল মালিক পক্ষ কোম্পানিটি নতুন ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেছে। তারা সবকিছু বুঝে নিতে এলেও বিশ্বজিত রায়ের লোকজন তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। তবে, প্রশাসনের সহায়তায় এখন প্রকৃত মালিকের হাতে গেছে কোম্পানিটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, বেঙ্গল ফাইন সিরামিক কোম্পানির প্রকৃত মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ার হস্তান্তরের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিএসইসি আইনের মধ্য থেকেই সিদ্ধান্ত দিয়েছে।