ফেনী প্রতিনিধি : ফেনীতে ভুল চিকিৎসায় আকিফা সুলতানা (৩৯) নামে এক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আকিফা সুলতানা ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন।
স্বজনদের অভিযোগ, ফেনী প্রাইভেট হাসপাতাল নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ডা. কাইয়্যুমের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আকিফার মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) রাতে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন ডা. আকিফা সুলতানার চাচা ইকরাম উল্ল্যাহ। তিনি জানান, গত ২২ জুন ঢাকায় নেওয়ার পথে তার ভাতিজি মারা যান।
ডা. আকিফা সুলতানা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার বাহাদুর গ্রামের মো. গোলাম মোস্তফার দ্বিতীয় সন্তান। তিনি পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাবার ফ্ল্যাটে থাকতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি অবিবাহিত ছিলেন।
ডা. আরিফা সুলতানা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে চিকিৎসা পেশায় যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিনিয়র ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ জুন রাতে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন হিসেবে পরিচিত প্রফেসর ডা. কাইয়্যুমের ব্যক্তি মালিকানাধীন হাসপাতালটিতে ডা. আকিফা সুলতানার ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সার্জারির আগে তাকে এনস্থেশিয়া দেওয়া হয়। এসেস্থিশিয়া প্রয়োগ করেন ডা. আবদুর রহমান। এর পর থেকেই আকিফার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পরিস্থিতি ভালো নয় দেখে সেখান থেকে তাকে প্রথমে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। কোনো উন্নতি না হওয়ায় পরদিন ২২ জুন ভোরে চট্টগ্রাম এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যান ডা. আকিফা।
আকিফার চাচা ইকরাম উল্ল্যাহ বলেন, আমার ভাতিজি ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে চিকিৎসা পেশায় যোগদান করে। সর্বশেষ মোহাম্মদপুরের বাসায় থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে কর্মরত ছিল। তার এক সময়ের রুমমেট ফেনীতে কর্মরত ডা. নিলুফা পলির কথায় সে ফেনীতে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করাতে যায়।
ইকরাম উল্ল্যাহ বলেন, আকিফা একজন অভিজ্ঞ ও সিনিয়র এনেস্থেশিওলজিস্ট চিকিৎসক চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মালিক ডা. কাইয়্যুম বয়োবৃদ্ধ একজনকে নিয়ে আসেন। বয়সের ভারে ওই এনেস্থেশিওলজিস্ট নিজেই অসুস্থ। এনেস্থেশিয়া দেওয়ার পরই আমার ভাতিজির শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে।
তিনি বলেন, ভুল এনেস্থেশিয়া দেওয়ার পর শুক্রবার (২১ জুন) রাত ১০টার দিকে ফেনী প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে আমাদের ফোন করে বলা হয় ঢাকা থেকে যেন আইসিইউ সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফেনীতে যাই। রাত ৩টায় আমরা ফেনী জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে ডা. আকিফাকে আইসিইউতে সংকটাপন্ন অবস্থায় দেখতে পাই। তখন সেখানে অবস্থান করা হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক ডা. আকিফাকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার স্বার্থে চিকিৎসকদের পরামর্শে দুইজন চিকিৎসকসহ চট্টগ্রাম এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু এভারকেয়ারের মেডিকেল বোর্ড থেকে আমাদের জানায়, ফেনী প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর তার শারীরিক অবস্থার আর অবশিষ্ট কিছু নেই। ওই অবস্থায় তাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আনার কোনো সুযোগ নেই। তারা আশা ছেড়ে দেন। এরপর আমরা তাকে ঢাকায় নেওয়ার জন্য রওনা হই। কিন্তু পথেই সে মারা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনী জেনারেল হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, সেদিন সারা রাত ফেনী জেনারেল হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক আকিফাকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন তারা।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফেনী প্রাইভেট হাসপাতালের মালিক ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন প্রফেসর ডা. কাইয়্যুম বলেন, এনেস্থেশিওলজিস্ট চিকিৎসকের বয়স ও অভিজ্ঞতা নিয়ে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ বয়স বাড়লেই যে চিকিৎসা ভুলে যান এমন নয়। এনেস্থেশিয়া দেওয়ার জন্য ডা. আবদুর রহমানের সঙ্গে স্থানীয় একজন জুনিয়র চিকিৎসকও উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে এনেস্থেশিওলজিস্ট ডা. আবদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি।
এদিকে গত রোববার (২৩ জুন) এ ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ফেনী সিভিল সার্জন কার্যালয়।
কমিটিতে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. জালাল হোসেনকে সভাপতি করা হয়েছে। এতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি) ডা. মো. কামরুজ্জামান, দাগনভূঞা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌহিদুল ইসলাম, ফেনী জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি) ডা. তাহিরা খাতুন ও জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেস্থেশিয়া) ডা. মো. ইলিয়াছ ভূঞা।
ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. শিহাব উদ্দিন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের নির্দেশনা মোতাবেক সার্জারি করার সময়ে জটিলতার প্রেক্ষিতে রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।