নিউজ ডেস্ক:
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগীদের অংশগ্রহণ নিয়ে ছিল নানান প্রশ্ন। তবে উন্নয়ন সহযোগীরা আশ্বস্ত করেছে প্রকল্পের আওতায় ঋণ, অনুদানসহ সব ধরনের সহায়তা আগের মতোই অব্যাহত থাকবে। কোনো ধরনের ব্যত্যয় হবে না। তারপরও বিশাল অংকের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করাই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, চীন, জাইকা, ভারত, রাশিয়া, ইউরোপীয় উন্নয়নসহ উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে এরই মধ্যে বৈঠক করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। সেখানে আশ্বস্ত করেন দাতারা।
ইআরডির এশিয়া, জেইসি ও এফঅ্যান্ডএফ শাখার প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মিরানা মাহরুখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পরে আমরা জাপান, এআইবি, চীন ও ভারতের সঙ্গে রুটিন বৈঠক করেছি। আগে যেভাবে তারা আমাদের পাশে ছিল এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনো কিছুতে ব্যত্যয় হবে না। কোরিয়া, জাপানের ঋণে চলমান প্রকল্পের বিষয়ে মিটিং করেছি। তারাও আমাদের সাধারণভাবে ঋণ-অনুদান দিচ্ছে।’
সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের দায় (আউটস্ট্যান্ডিং বা বকেয়া) বেড়ে হয়েছে ৬৯ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৬ বা ৭ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার বেশি। ২০২৬ সালের পরে অনেক মেগা প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হবে। তখন বড় অংকের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এসময় এমন কোনো প্রকল্প চালু হবে না যা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয়।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঋণ সুদের ব্যয় বেশি, বাজেটের রাজস্ব আদায়ও কম। সরকারি যে আয় তাতে সুদের ব্যয় ও সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন দিয়ে বেশি টাকা থাকে না, যা দিয়ে অন্য জায়গায় খরচ করা যায়। ফলে বিনিয়োগ ধার করে করতে হবে।’
‘২০২৬ সালে পরে এমন কোনো প্রকল্প অবদান রাখবে না যা দিয়ে সরকারের আয় বাড়বে। ২০২৭ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ বড় অংকে বাড়বে। বেশ কিছু প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে অথবা ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। বোঝা বাড়বে করদাতার ওপর। বিশেষ করে দেশের সব মানুষের ওপর।’
২০২৬ সালে পরে এমন কোনো প্রকল্প অবদান রাখবে না যা দিয়ে সরকারের আয় বাড়বে। ২০২৭ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ বড় অংকে বাড়বে। বেশ কিছু প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে অথবা ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। বোঝা বাড়বে করদাতার ওপর। বিশেষ করে দেশের সব মানুষের ওপর।- ড. জাহিদ হোসেন
ঋণ-অনুদান দিয়ে পাশে থাকার প্রত্যয় উন্নয়ন সহযোগীদের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক ঋণ এসেছে ৯২ দশমিক ৩৬৭ বিলিয়ন ডলার। এসময় বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের অনুদান পেয়েছে ৩০ দশমিক ১০৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট উন্নয়ন সহযোগিতা পেয়েছে ১২২ দশমিক ৪৭২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে খাদ্য সহায়তা বাবদ ৭ দশমিক ০৩১ বিলিয়ন ডলার, পণ্য সহায়তা বাবদ ১০ দশমিক ৯০৮ বিলিয়ন ও প্রকল্প সহায়তা বাবদ এসেছে ১০৪ দশমিক ৫৩৩ বিলিয়ন ডলার।
একক সংস্থা বা দেশের মধ্যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে, যার পরিমাণ ২৮ দশমিক ৪৪৬ বিলিয়ন ডলার। যা মোট উন্নয়ন সহযোগিতার ২৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। সংস্থাটি এ সহায়তার আওতায় অনুদান দিয়েছে ১ দশমিক ৬২৩ বিলিয়ন ডলার। বাকি ২৬ দশমিক ৮২৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
বাংলাদেশের ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে কোনোভাবেই উদ্বিগ্ন নয় বিশ্বব্যাংক। বরং বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে চায় সংস্থাটি। অন্তর্বর্তী সরকারকে সব বিষয়ে সহায়তা দিয়ে পাশে থাকতে চায় বিশ্বব্যাংক।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেকের সঙ্গে বৈঠক করেন। ইআরডির বিশ্বব্যাংকের প্রধান (অতিরিক্তি সচিব) ফরিদ আজিজ বলেন, বিশ্বব্যাংক আমাদের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। আগের মতোই সব প্রকল্পে ঋণ-অনুদান চলমান। ঋণ নিয়ে বিশ্বব্যাংক উদ্বিগ্ন নয়। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে। আমরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নিয়িমিত বৈঠক করছি।
ঋণ-অনুদানে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশকে এখন পর্যন্ত ২২ দশমিক ৪২৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা করেছে। উন্নয়ন সহযোগিতায় যা ১৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। সংস্থাটি বাংলাদেশকে অনুদান দিয়েছে মাত্র ৩৮২ মিলিয়ন ডলার। বাকি ২২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারই দিয়েছে ঋণ হিসেবে। যদিও এডিবি কখনোই বাংলাদেশকে খাদ্য সহায়তা দেয়নি। তবে পণ্য সহায়তার আওতায় কিছু ঋণ দিয়েছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশের নানা উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে সব ধরনের সহায়তা দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের টিম লিডার গোবিন্দ বার বলেন, এডিবি বাংলাদেশকে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন করার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে টেকসই উন্নয়নকে আমরা সমর্থন করি। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। চলমান প্রকল্পের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই উন্নয়ন করা হবে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সহায়তা অব্যাহত রাখবে এডিবি।
ইআরডি জানায়, জাপান বাংলাদেশকে সহায়তার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে। ৫২ বছরে দেশটি ২০ দশমিক ৪৫২ বিলিয়ন ডলার বা ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ সহায়তা দিয়েছে। চতুর্থ অবস্থানে চীন। দেশটি বাংলাদেশকে ৮ দশমিক ১১৫ বিলিয়ন ডলার বা ছয় দশমিক ৬৩ শতাংশ সহায়তা দিয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীর তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে থাকা রাশিয়া গত ৫২ বছরে বাংলাদেশকে ৬ দশমিক ৮৭৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে, যা মোট সহায়তার পাঁচ দশমিক ৬১ শতাংশ। উন্নয়ন সহযোগীর তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংগঠন পুরো অর্থই বাংলাদেশকে অনুদান হিসেবে দিয়েছে। ৫২ বছরে এ সহায়তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৭৯৫ বিলিয়ন ডলার বা তিন দশমিক ৯২ শতাংশ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ৩ দশমিক ৮৫৬ বিলিয়ন ডলার বা তিন দশমিক ১৫ শতাংশ সহায়তা দিয়ে রয়েছে সপ্তম স্থানে।
যুক্তরাজ্যের সহায়তার পরিমাণ ২ দশমিক ৭২৭ বিলিয়ন ডলার বা দুই দশমিক ২৩ শতাংশ। উন্নয়ন সহযোগিতায় যথাক্রমে নবম ও দশম স্থানে থাকা জার্মানি বাংলাদেশকে ২ দশমিক ২৫১ বিলিয়ন ডলার। কানাডা দিয়েছে ২ দশমিক ২১৪ বিলিয়ন ডলার বা এক দশমিক ৮১ শতাংশ। ভারত বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়েছে ২ দশমিক ১৪৩ বিলিয়ন ডলার।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংক (এআইআইবি), ইউনিসেফ, ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি), নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, ডেনমার্ক এবং সৌদি আরবের উন্নয়ন সহযোগিতার পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি।
দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে। নানা সংকটের কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই বছর বাড়তি সময় দেওয়ার অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। এখন সরকার চাচ্ছে ২০২৯ সালের ১৫ মার্চ প্রথম কিস্তি দিতে। এটা চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। ফলে ২০২৭ সালের পর বেশি কিছু প্রকল্পে ঋণ পরিশোধের চ্যালেঞ্জ বাড়বে বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। সূত্র : জাগোনিউজ