আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও শাটডাউনকে কেন্দ্র করে যখন টালামাটাল দেশের অর্থনীতি, ঠিক তখনই বাংলাদেশের ঋণমান বা ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিয়েছে বিশ্বের খ্যাতনামা ঋণমান বা ক্রেডিট রেটিং যাচাইকারী কোম্পানি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ঋণমান ‘বিবি মাইনাস’ থেকে কমিয়ে ‘বি প্লাস’ করেছে। দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে, সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের ঋণমান কমানো হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্বের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালকে। অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান মুডিস ও ফিচ রেটিংস বাংলাদেশের ঋণমান আগেই হ্রাস করেছিল।
এদিকে এসএন্ডপি গ্লোবালের এই ক্রেডিট রেটিং হ্রাসের বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এর প্রভাবে বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. রাদ মুজিব লালন সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের গ্লোবাল রেটিং যদি কোনো কারণে নিম্নমুখী হয়, তবে আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে রেটিং কমে যায়। এ অবস্থায় আমরা যদি কোনো বৈদেশিক ঋণের জন্য আবেদন করি, অথবা বিদেশি তহবিলের জন্য আবেদন করি; সে ক্ষেত্রে আমাদের ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। যেমন: আমরা যখন আমাদের দেশের কোনো ক্লায়েন্টের জন্য ক্রেডিট রেটিং করি, আমরা এটাকে বলি ইন্টারন্যাল ক্রেডিট রেটিং স্কোর। এই স্কোর যত বেশি থাকে ওই ক্লায়েন্টের রেটিংটা তত বেশি ভালো থাকে। আর যত কম থাকে, তত তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এ পরিস্থিতিতে তাকে ঋণ এবং ফান্ডিং না করার জন্য আমরা সুপারিশ করে থাকি। একইভাবে যদি দেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিংটা খারাপ হতে থাকে, তাহলে বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।’
এই ক্রেডিট রেটিং হ্রাসের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়তে যাচ্ছে উল্লেখ করে ড. রাদ মুজিব বলেন, ‘আমাদের বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এ ছাড়া আমাদের যে অবকাঠামো প্রকল্পগুলো চলছে, বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলোতে ফান্ডিং প্রয়োজন হবে। এসব ক্ষেত্রে ফান্ডিংয়ের জন্য সরকারকে বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এই ক্রেডিট রেটিংয়ের প্রভাব যদি তহবিল ছাড় করার ওপর পড়ে, সে ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদেই আমাদের অবকাঠামো খাতে এই ক্রেডিট রেটিংয়ের প্রভাব পড়তে পারে। আর দীর্ঘ মেয়াদে এই ক্রেডিট রেটিংয়ের নিম্নমুখী প্রবণতার প্রভাব আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর পড়তে পারে। কারণ, দেশের জিডিপির ওপরও ক্রেডিট রেটিংয়ের একটা প্রভাব রয়েছে। দেশে ভলিউম অব ট্রানজিশন যত বাড়ে জিডিপির গতি তত বৃদ্ধি পায়। যদি ঋণ ও তহবিলের অভাবে স্বল্প মেয়াদে আমাদের অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর কাজ থমকে যায় বা এর গতি মন্থর হয়ে পড়ে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাবে আর্থিক খাতের লেনদেনের গতিও মন্থর হয়ে পড়বে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের জিডিপি।’
এদিকে বাংলাদেশের বহিঃস্থ তারল্য দুর্বল হচ্ছে উল্লেখ করে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ধারাবাহিক পতনের ঘটনায় এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বলে তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল।
ব্লুমবার্গে এ ব্যাপারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের এই রেটিং হ্রাসের বিষয়টি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমাবনতির মাধ্যমে বাংলাদেশের বহিঃস্থ তারল্যের ওপর ক্রমাগত চাপের বিষয়টিই নির্দেশ করছে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ব্যাপারে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের এই পর্যবেক্ষণের তাৎপর্য সম্পর্কে ড. রাদ মুজিব লালন বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের রিজার্ভ এমনিতেই চাপে রয়েছে। আমাদের রিজার্ভের প্রধান দুটি উৎস: রেমিট্যান্স ও রফতানি। কিন্তু কিছুদিন ধরেই আমাদের অভ্যন্তরীণ নানাবিধ কারণে রেমিট্যান্সের প্রবাহে মন্দাভাব বিরাজ করছে। এর মধ্যে যদি সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রভাবে সামনের দিকে আমাদের রফতানিটাও বাধাপ্রাপ্ত হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই তা আমাদের রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
এ পরিস্থিতির প্রভাবে ডলারের বিপরীতে টাকা তার মান ধরে রাখতে পারবে কি না, সে ব্যাপারেও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি ডলারের সংকট দেখা দিতে পারেও বলে মনে করছেন তারা।
এ ব্যাপারে ড. রাদ মুজিব বলেন, যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তবে সামনের দিকে ডলারের সংকট দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে মুদ্রা বিনিময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রলিং পেগ পদ্ধতির কারণে বাজারের বিপরীতে মুদ্রার মূল্যমানের স্বাভাবিক ওঠানামার যে গতি, সেখানেও এক ধরনের বাধা আরোপ করে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ও রফতানি হ্রাস পেলে রিজার্ভ ক্রমেই নিম্নমুখী হবে। মূলত বাংলাদেশের আর্থিক খাত সম্পর্কে এই বার্তাই দিতে চেয়েছে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। সম্প্রতি খোলাবাজারে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার মূল্যমান ১২৫ টাকায় উঠে যাওয়ার বিষয়টি তারই ইঙ্গিত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সামনে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও কমবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ড. রাদ মুজিব। এর প্রভাবে সামনের দিকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিংয়ের আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ড. রাদ মুজিব বলেন, ‘রিজার্ভ যদি নিম্নমুখী হয়, তবে সামনের দিকে আমাদের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য আমরা যে ঋণগুলো নেব, সেগুলোর কিস্তি পরিশোধ কীভাবে করা হবে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন রয়ে যাবে। যদি আমাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য হ্রাস পায়, তবে আমাদের ক্রেডিট রেটিং আরও কমে যাবে।’
ক্রেডিট রেটিংয়ের এই ক্রমাবনতি বৈদেশিক ঋণদাতা ও সহায়তা প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বাংলাদেশকে ঋণ ও তহবিল সহায়তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলতে পারে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ড. রাদ মুজিব। এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা স্থগিতের বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি।
গত বছর ২৫ অক্টোবর নতুন ইইউ-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে ৪০ কোটি ইউরো অর্থায়নের লক্ষ্যে ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। এ ছাড়া আরও পাঁচটি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাবদ সাত কোটি ইউরোর চুক্তিও সই হয়।
ক্রেডিট রেটিং কমতে থাকলে বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে আইএমএফ, জাইকাসহ অন্যান্য ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সিদ্ধান্তেও এই বিষয়গুলো প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি যে ইনস্টলমেন্ট চলমান রয়েছে, সেগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে অন্যান্য আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থার রেটিংয়ে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের এই রেটিং প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. রাদ মুজিব বলেন, সাধারণত একটি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট সংস্থার রেটিংয়ের প্রভাব অন্য ক্রেডিট রেটিং সংস্থার ওপরও পড়ে। তারা নতুন করে রি-রেটিং বা নতুন করে রেটিং করতে পারে। এ ব্যাপারে অপর আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ফিচ কর্তৃক গত মে মাসে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং হ্রাসের উদাহরণ দেন তিনি। সব মিলিয়ে এই ক্রেডিট রেটিং সামনের দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন দিকে যেতে পারে তার একটি পূর্বাভাস বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি নতুন করে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য নির্ধারণে বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণীত ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতির বদলে তা পুরোপুরি বাজারের ওপর ‘ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই’ পদ্ধতির ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে ড. রাদ মুজিব বলেন, যদি বাজারের ওপর ডলারের বিনিময় হার ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে দেশের রফতানিকারক ও রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা লাভবান হবেন। সে ক্ষেত্রে যেহেতু ব্যাংকের দর ও বাজারের দর একই থাকবে তখন রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা হুন্ডির বদলে বৈধভাবেই দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হবেন। এ ছাড়া রফতানিকারকরাও লাভবান হবেন। কারণ, অভ্যন্তরীণ মুদ্রার মান যদি হ্রাস পায় তাহলে রফতানি বেড়ে যাবে, ফলে তারাও লাভবান হবেন। তাই দীর্ঘে মেয়াদে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখতে মুদ্রা বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়াই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে উল্লেখ করেন ড. রাদ মুজিব।