১৫ শতাংশ সুদ দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দুঃসাধ্য: ব্যবসায়ীরা

নিউজ ডেস্ক:
কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগ জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলছেন, ১৪-১৫ শতাংশ সুদ দিয়ে ব্যবসা করে বিশ্বের কোনো দেশে মুনাফা করা যায় না। ঋণের সুদ ৯ থেকে বেড়ে ১৬ শতাংশ হয়ে গেছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ব্যবসা বাংলাদেশে এসেছে।

সেগুলো রাখতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। ঋণের সুদ নিয়ে বসে আলোচনা করা দরকার। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন তাঁরা।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ। এ সময় বক্তব্য দেন শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী এবং বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ।

সেমিনারের সূচনা বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, কভিড-পরবর্তী সময় থেকে আমরা নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তবে সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প-কারখানায় অসন্তোষের কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকঋণের সুদের উচ্চ হার এবং সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার অস্থিতিশীলতার কারণে বেসরকারি খাত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতির সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তিনি আরো বলেন, দেশের ভালো ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট রয়েছে, ফলে উদ্যোক্তারা প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণ পাচ্ছেন না, সেই সঙ্গে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা শিল্প খাতে পণ্য উৎপাদনকে ব্যাহত করছে, ফলে স্থানীয় চাহিদার জোগান মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি সমন্বিত রাখা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিল্পাঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা কষ্টে আছি। আজকে আমার কারখানায় যেতে ভয় লাগে। ভয় লাগে এই জন্য যে আমি কি নিজের জীবন নিয়ে বের হয়ে আসতে পারব? এভাবে ব্যবসায়ীরা যদি নিজেদের কারখানায় যেতে শঙ্কিত হন, তাহলে তাঁরা আগামী দিনে ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন না।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে যাঁরা শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষ উসকে দিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান আহসান খান চৌধুরী। বলেন, “বর্তমানে যাঁরা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতায় অন্যায় সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের শিক্ষা দিতে হবে।

আমাদের দেশে কখনোই ‘দিতে হবে, দিতে হবে’, দাবি মানতে হবে’—এমন সংস্কৃতি ছিল না। আমরা বিগত দিনে কারখানাগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করেছি। আমরা সেই সংস্কৃতি ফিরে পেতে চাই।” তিনি আরো বলেন, ‘ব্যবসা পরিচালনার জন্য আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি একটি মৌলিক বিষয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগামী দিনে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ১৫ শতাংশের বেশি ব্যাংকঋণের সুদ দিয়ে পৃথিবীতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা খুবই দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার, তবে আমাদের উদ্যোক্তাদের সেটা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে কাস্টম হাউসে দুর্নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যেটি নিরসনে সরকারের ফিন্যানশিয়াল রিফর্মস কমিটি গঠন করার পাশাপাশি অটোমেশন নিশ্চিত করা জরুরি।

মীর নাসির হোসেন বলেন, বর্তমান সরকার এখনো ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ব্যবসায়ীদের কথা শুনতে হবে। তাঁদের অবদান স্বীকার করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব অব্যবস্থাপনা ছিল, সেগুলো সংস্কার করতে হবে। তবে সেখানে এখনো কোনো উদ্যোগ দেখছি না। দেশে মধ্যম আয়ের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যাদের করজালের আওতায় নিয়ে আসা গেলে জিডিপিতে রাজস্বের অবদান অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং লাভবান হবে আমাদের অর্থনীতি।

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, বর্তামন প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতরা মধ্যে রয়েছেন, যা উত্তরণে শিল্পাঞ্চলে বিশেষ করে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে, পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বন্ধ। এফডিআই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ডলারের জন্য নয়, বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়া যায়। রপ্তানি পণ্যের বাড়তি দাম পাওয়া যায়। বর্তমানে যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করলেই বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলবে।

এ ছাড়া প্রশাসনের অনেক জায়গা থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, এ ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট বার্তা প্রদান করা আবশ্যক। তিনি বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্থানীয়ভাবে আমাদের চাহিদা কমে গেছে, যেটা উদ্বেগের বিষয়, সেখানে সবাইকে নজর দিতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ডাবল ডিজিটের সুদ দিয়ে ব্যবসায় মুনাফা করা অসম্ভব।’

বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদ্যমান শ্রমিক অসন্তোষ কার্যক্রমে অনুপ্রবেশকারীদের হাত রয়েছে। এরই মধ্যে শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি শ্রমিকদের যেকোনো যৌক্তিক দাবি বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ ইতিবাচকভাবে মেটাতে বদ্ধপরিকর।

ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বর্তমান সময়ে তৈরি পোশাক খাতের ঝুট ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্প-কারখানায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়। যেকোনো মূল্যে এই পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে ইমেজ সংকটে পড়তে পারে।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, শিল্প খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যেটি মোটেই কাম্য নয়। সরকারকে এ বিষয়টিতে নজর দেওয়া জরুরি।

মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, গত মাসের বন্যা ও পার্বত্য এলাকায় অস্থিরতার ফলে স্থানীয় পর্যটন ব্যবসা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, সেই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশে ভিসা জটিলতার কারণেও এই খাতে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে ই-কমার্স খাতের উন্নয়নে আস্থার পরিবেশ উন্নতির কোনো বিকল্প নেই।

ফুডপান্ডা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং সিইও আমব্রারিন রেজা বলেন, গত তিন মাসে ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় বিশেষ করে ডিজিটাল সেবা খাতের ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং এই খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই এসএমই, যাঁদের ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করতে দ্রুততম সময়ে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদান করা জরুরি।

ঢাকা চেম্বারের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দসহ বেসরকারি খাতের আমন্ত্রিত অতিথিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ক্ষতি সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা: সিপিডি
পরবর্তী নিবন্ধসেনাবাহিনীতে সৎ-নীতিবান অফিসাররাই পদোন্নতির দাবিদার : প্রধান উপদেষ্টা