নিজস্ব প্রতিবেদক : সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনা মহামারিতে নাজুক বিশ্ব অর্থনীতিকে গুরুতর চাপে ফেলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আমি প্রথমেই এই যুদ্ধকে যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করার জন্য সকলকে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, এ যুদ্ধ যত দ্রুত বন্ধ করা সম্ভব হবে; বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা ও জ্বালানি সঙ্কটের হুমকিকে কাটিয়ে উঠা সম্ভবপর হবে।
বুধবার (৮ জুন) ভেলা-৩ আসনের এমপি আলী আজমের টেবিলে উপস্থাপিত নির্ধারিত লিখিত প্রশ্নোত্তরে তিনি এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠক শুরু হয়।
আলী আজমের লিখিত একই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হ্যাঁ, সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিবের আমন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি ও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
‘আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন; ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য খাদ্য, জ্বালানি এবং সারের আকাশছোঁয়া দামের কারণে বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশগুলোতে সৃষ্ট খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলায় সহায়তা করার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের নেতৃত্বে গত ১২ এপ্রিল এই গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব আমাকে আমন্ত্রণ জানান- যা আমি গ্রহণ করি। আমি ছাড়াও আরও ৫ জন বিশ্বনেতা এই ক্রাইসিস গ্রুপের ‘চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে কাজ করবেন; যাদের মধ্যে রয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি, সেনেগালের রাষ্ট্রপতি ও বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্রাইসিস গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আমরা সৃষ্ট বৈশ্বিক সঙ্কট প্রতিরোধ এবং প্রশমিত করতে বিশ্বব্যাপী ঐক্যমত গঠনে সমর্থন ও সহায়তা করব। গত ২০ মে আমি জাতিসংঘ মহাসচিব এবং অন্যান্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে এই সংক্রান্ত একটি উচ্চ পর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে অংশগ্রহণ করি। এই ভার্চুয়াল বৈঠকে তিনটি প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব উপস্থিত বিশ্বনেতাদের সামনে খোলামেলা আলোচনা করেন। বিষয়গুলো হলো: অর্থ সঙ্কট, খাদ্য নিরাপত্তা এবং বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা ও জ্বালানি সঙ্কটের হুমকিকে কাটিয়ে উঠা সম্ভবপর হবে। এ বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে বিশ্বনেতৃবৃন্দকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করি। তাছাড়া আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে জ্বালানি সঙ্কট এবং আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য যাতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, সে ব্যাপারেও আমি আশাবাদ ব্যক্ত করি।
‘বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে উল্লেখ করি- বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় দৃঢ় বিশ্বাসী। আমরা অন্যদের সুবিধার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন, জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং পরিবেশগত অবনতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের জ্ঞান, বোঝাপড়া এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই। আমরা আমাদের রপ্তানি খাত ও এসএমইকে সমর্থন করার জন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিয়েছি। ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো আমাদের গত অর্থবছরে ৬.৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করেছে। আমরা আমাদের প্রচেষ্টায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার প্রদান করেছি। যারা সবচেয়ে পেছনে রয়েছে তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য আমরা সামাজিক সুরক্ষার আওতা প্রসারিত করেছি। মহামারি কাটিয়ে উঠার লক্ষে সরকার কর্তৃক সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে জীবন-জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের এ সঙ্কটকালে জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত গ্রুপে ‘চ্যাম্পিয়ন’ হওয়ার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব কর্তৃক আমাকে আমন্ত্রণ জানানো এবং অন্যান্য বিশ্বনেতাদের সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া মূলত বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিশ্বনেতৃত্বের আস্থা এবং মহামারি করোনা সঙ্কট মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের সাফল্য, দেশের আর্থিক-সামাজিক অগ্রগতির আন্তর্জাতিক বহিঃপ্রকাশ বলে আমি মনে করি।’
এ কে এম রহমাতুল্লাহর (ঢাকা-১১) লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী যোগান ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তথাপি বর্তমান সরকারের দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নীতি-উদ্যোগের কারণে কৃষি খাতসহ অন্যান্য আর্থ-সামাজিক খাতসমূহে বাংলাদেশের অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। কোভিড সংক্রমণের কারণে যাতে দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত না হয়, সেজন্য বর্তমান সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করে। এ ছাড়া সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তা করা হয়ে থাকে। দেশে জিডিপিতে কৃষি খাতের আপেক্ষিক গুরুত্ব হ্রাস পেলেও ২০০৫-২০০৬ থেকে কৃষি জিডিপি ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের মোট শ্রমক্ষম মানুষের একটি বিরাট অংশ কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত। ২০০৯ সালে আমরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন।
তিনি বলেন, বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে বাংলাদেশ ধান ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বে ৩য়, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু উৎপাদনে ৭৯, চা উৎপাদনে ৪র্থ স্থানের পাশাপাশি ১১টি ইলিশ মাছ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে থেকে বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমণ্ডলে সমাদৃত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থা একটি সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ের চাহিদা এবং প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি খাতকে এগিয়ে নিতে সবুজায়ন বৃদ্ধি এবং জলবায়ু সহনশীল ও ডিজিটালাইজড কৃষির বিপ্লবে বর্তমান সরকার কাজ করছে। সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশনের আওতায় কৃষি খাতে ডিজিটাল কৃষক প্রোফাইল তৈরি, স্মার্ট কার্ড বিতরণ, ডিজিটাল কৃষি তথ্য বিশ্লেষণ ও তথ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও অধিকতর ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে কাজ করছে। কৃষকদের ভাগ্যের উন্নয়নে বর্তমান সরকার সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং কৃষি প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন, কৃষিঋণ, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ, ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ই-কৃষির প্রবর্তন, জলবায়ু ও ঝুঁকি সহনশীল ফসলের জাত-প্রযুক্তি উদ্ভাবন ইত্যাদির ব্যবস্থা করছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ (এফএও) অন্যান্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ফোরামে বাংলাদেশ বারংবার কৃষিখাত সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির সহজ শর্তে হস্তান্তর নিশ্চিত করার কথা বলে আসছে। এ ছাড়াও মাথাপিছু কৃষি জমির পরিমাণ মাত্র ০.০৪৮ হেক্টর হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ নিজস্ব খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন এবং বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় উত্তরোত্তর কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।