বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ থাকলেও সংকট নেই : ড. দেবপ্রিয়

নিজস্ব প্রতিবেদক : বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ’ (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও বিশিষ্ট বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, অর্থনীতির রোগ নির্ণয় হয়েছে এবং এ বিষয়ে ঐকমত্যও আছে। এখন দরকার নিরাময়। কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, তার উপায় খুঁজে বের করা জরুরি। এ জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে দেশের অর্থনীতিতে চাপ থাকলেও সংকট নেই। এ মুহূর্তে জিডিপি সংযত করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই হবে প্রধান কাজ।
মঙ্গলবার ‘ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম’ (ইআরএফ)-এর এক ডায়ালগ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা আর্থিক খাত, তথা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা। টাকার অভাবে জ্বালানিতে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিতে পারছে না সরকার। অথচ, আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে মেতে আছি। আমি বলব, উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে দরিদ্র সরকার। সংকট মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণে বেশি মনোযোগ দিতে হবে সরকারকে।
তিনি বলেন, আগামী দুই-তিন মাস মাসের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে যারা মন্তব্য করেছেন, তাদের ধারণা ঠিক নয়। এ ধরনের মন্তব্যে বাজারে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আগামী ২০২৪ সালের আগে পরিস্থিতির স্বাভাবিক হবে না।’
ড. দেবপ্রিয় বলেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, ফলে টাকা পাচারের প্রবণতা বাড়ে। কাঠামোগত সংস্কার না হলে এটি ঠেকানো সম্ভব নয়। যদি বৈষম্য বাড়ে এবং এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হয়, তাহলে সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হয়। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না। প্রতিযোগিতাসক্ষম মেধাভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানসম্মত বেসরকারি খাত গড়ে না তুলতে পারলে টেকসই উন্নয়ন হবে না।
‘গত এক দশকে বাংলাদেশের অনেক সাফল্য আছে’ এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ সময় নিম্ন আয় থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, এলডিসির তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ে বড় উলম্ফন এবং ভৌত অবকাঠামো খাতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। তবে এই সাফল্যের পাশাপাশি অর্থনীতিতে নানা বিচ্যুতি হয়েছে।
ড. দেবপ্রিয়’র মতে, অর্থনীতিতে চার ধরনের বিচ্যুতি রয়েছে। প্রথমত: আমাদের যে জিডিপি হয়েছে, তা মূলত সরকারি খাতের বিনিয়োগ নির্ভর। ব্যক্তি খাতে তেমন বিনিয়োগই হয়নি। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই জিডিপি’র মাত্র ১ শতাংশ। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টিকে এভাবে বলা যায়: প্লেন এক ইঞ্জিন দিয়ে চলছে, দ্বিতীয় ইঞ্জিন নেই। ফলে এই প্লেন বেশি দূর যেতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত বিচ্যুতি হচ্ছেÑ আর্থিক খাতে দুর্বলতা। জাতীয় আয় বেড়েছে, অথচ রাজস্ব আহরণ সেভাবে হয়নি। বিশেষ করে প্রত্যক্ষ করে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। আয় কম, ব্যয় কম। ফলে ঘাটতিও কম।
তৃতীয় বিচ্যুতিÑ ভৌত অবকাঠামো খাতকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সেভাবে হয়নি। ২০ মেগা প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে জিডিপি ২ শতাংশ। অথচ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপি’র এক শতাংশের নিচে। মূলত, রাজনৈতিক কারণে সরকার অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে।
‘চতুর্থত, সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ খুবই কম।’
ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনীতিতে এসব বিচ্যুতি শুরু হয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকে। তারা প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারেনি। বিশেষ গোষ্ঠীদেরকে সুবিধা দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, কীভাবে বিদ্যুৎ খাতে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া হয়েছে। এখন এলএনজি’র ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। এভাবে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়ে অর্থনীতিতে বিচারহীনতার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। অতি মূল্যায়িত উন্নয়ন প্রকল্পে একই সুবিধা দেয়া হয়েছে, যার দায় এসে পড়েছে জনগণের উপরে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প’ আর্থিকভাবে লাভজনক হবে কি না Ñতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু হবে না আমরা কখনও এ কথা বলিনি। আমরা এর অর্থায়ন পদ্ধতি নিয়ে বলেছিলাম। পদ্মা সেতুর জন্য অবশ্যই বর্তমান সরকার প্রশংসা দাবি রাখে।
জ্বালানি তেলের দাম কমানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৪০ টাকা নিয়ে ৫ টাকা ফেরত, এটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সমন্বয়হীনতার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এটা কি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না আর্থিক সিদ্ধান্ত? সিদ্ধান্তগুলো কোথায় হচ্ছে? এই যে অ্যাডহক বা অস্থায়ী বেসিসে এটা করেন, হঠাৎ হঠাৎ ধারাবাহিকতাহীনভাবে করেন, তাহলে সংকট হবে। মূলত দক্ষতার অভাবে এটা হয়েছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে তেলের দাম কমছে। তবে পণ্যমূল্যে বড় কোনো পতন আমরা দেখি না। বরং গত দুই সপ্তাহে যদি দেখেন তবে দেখবেন খাদ্য মূল্য বরং বেড়েছে। বাজার বৃদ্ধি ও টাকার মূল্যমান কমার কারণে এগুলো হয়েছে।
ড. দেবপ্রিয়’র মতে, বাংলাদেশে অর্থনীতিতে প্রারম্ভিক লুণ্ঠন শুরু হয় আশির দশকে। ‘শিল্প ব্যাংক’ ও ‘শিল্প ঋণ সংস্থা’ গঠন করে বেনামে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতির সূচনা হয়, যা আজও অব্যাহত আছে।
তার মতে, লুণ্ঠনের আরেকটি উৎস পুঁজিবাজার। এখানে অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। তৃতীয় লুণ্ঠন হচ্ছেÑ অতি মূল্যায়িত সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেয়া। ফলে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে খেটে খাওয়া উদ্যোক্তা শ্রেণি খুবই কম।
রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শারমিন রিনভী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এএসএম রাশিদুল ইসলাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমার্কেন্টাইল ব্যাংকের ২ উদ্যোক্তার শেয়ার বিক্রি সম্পন্ন
পরবর্তী নিবন্ধব্যাংক-বীমা খাতের শেয়ারের দাম কমলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রকৌশল- আর্থিক খাতের