নিজস্ব প্রতিবেদক : জ্বালানি তেল ও সারের মূল্যবৃদ্ধিতে চরম সংকটে পড়েছে কৃষি খাত। সারাদেশে ধানের উপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা করছেন প্রান্তিক কৃষকরা।
তেল, সার ও ফসল তোলায় ব্যয় হিসেব করলে লাভের আশা দেখছেন না তারা। হাল বাওয়া থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক কৃষকরা জানিয়েছেন, হাল চাষ, বিদ্যুৎ বিল, সার দেওয়া, ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কারে কামলা খরচ, ধান কাটা এবং মাড়াইয়ে যে ব্যয় বেড়েছে তাতে ফসল থেকে লাভ তো দূরে থাক, আবহাওয়া যদি অনুকূলে না থাকে তাহলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। আর যারা জমি বর্গা নিয়ে চাষবাদ করছেন, আগামীতে তাদের অনেকেই চাষাবাদে নিরুৎসাহিত হবেন বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার প্রান্তিক কৃষক হামিদ মিয়া বলেন, নিজের জমি তেমন একটা নেই। পরের জমিতে ফসল ফলিয়ে জীবন চলে। গায়ে খেটে কোনো মতে পরিবার নিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে আছি। তবে জ্বালানি তেল এবং সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ অনেক বেড়েছে। ফসলের দাম থাকলেও ধানের মৌসুমে আমরা ন্যায মূল্য পাই না। এতে করে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। তাই পরিস্থিতি এমন থাকলে আগামীতে জমিতে ফসল বোনা সম্ভব হবে না।
কিছুদিন আগে জমিতে তিন হাল বাইতে শতাংশ প্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা দিতে হতো, সেটা এখন ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। তেলের দাম বাড়ায় শতাংশ প্রতি হাল চাষে ২০ টাকা করে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, সারের দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ধামরাইয়ের চৌহাট্ট ইউনিয়নের প্রান্তিক কৃষক আবুল হোসেন।
তিনি বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ায় হাল চাষে শতাংশ প্রতি ২০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। ইউরিয়া সারের দাম প্রতি বস্তায় ৩০০ টাকা বেড়েছে। আর লাল পটাসের (এমওপি) বস্তা ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫০০ টাকা হয়েছে। এতে করে চাষাবাদ করে লাভের মুখ দেখা যাবে না।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জমিতে সেচের জন্য বিদুৎ বিল আগের তুলনায় শতাংশ প্রতি ২০ টাকা করে বেড়েছে। আগে শতাংশ প্রতি বিদ্যুৎতের জন্য দিতে হতো ৫০ টাকা এখন সেটা ৭০ টাকা হয়েছে। আগে সকাল ৬ টা থেকে ১০ পর্যন্ত কামলা নিলে ২০০ টাকা দিতে হতো। এখন ৩০০ টাকা দিয়েও কামলা পাওয়া যায় না। কামলার অভাবে সময়মত ধান উঠানো সম্ভব হয় না। তাই এভাবে সবকিছুর দাম বাড়তে থাকলে আগামীতে আর ফসল বোনা সম্ভব হবে না বলে জানান ধামরাইয়ের আরেক প্রান্তিক কৃষক ইউনুস মিয়া।
এদিকে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষি খাতে প্রভাব পড়বে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে না, কিন্তু কৃষকদের লাভ কিছুটা কম হতে পারে।
অন্যদিকে, সরকার গত ২৮ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সার পরিস্থিতি মনিটরিংয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে চাহিদার বিপরীতে দেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো বাড়তি দাম দিয়েই সার কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। শুধু তাই নয়, তাদের অভিযোগ মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার কিনতে হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। এতে করে অনেকে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা করছেন।
তবে দেশে কোনো সারের সংকট নেই,। সরকার নির্ধারিত দামেই সার বিক্রি হচ্ছে। পরিবহন খরচ নিয়ে সার বস্তা প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি পড়ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) ঢাকা জেলার সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকার সার ডিলার মো. আলাউদ্দিন।
তিনি বলেন, ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কিছুটা কমেছে। তবে বৃষ্টি কৃষকের আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। ‘উত্তরবঙ্গে সারের ক্রাইসিস রয়েছে। এ কারণে সারা দেশেই তদারকি শুরু করেছে সরকার। ঢাকা জেলায় সারের কোনো সমস্যা নেই। ডিলার পর্যায়ে সারের দাম বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। খুচরায় সাব-ডিলার ও বিএডিসির ডিলাররা হয়তো সারের দাম কিছুটা বেশি নিচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, সারের দাম যতই বাড়ুক না কেন, কৃষক তার জমি খালি রাখেন না। লাভ না হলেও কৃষিকাজ থেকে তারা বিমুখ হবেন না। তবে কৃষক যাতে ফসলের ন্যায দাম পায় সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকরাই আমাদের সম্পদ। তাদের ভর্তুকি বাড়িয়ে হলেও কৃষিকাজে উৎসাহ দিতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তবে, এবার আউশ ও আমনের আবাদ কম হয়েছে। আমনের ক্ষেত্রে জ্বালানির দাম ও সারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। এসব কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও মনে করছেন দেশের কৃষিবিদরা। তাই কৃষকদের কথা চিন্তা করে এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোরও তাগিদ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে কৃষক বাঁচলে, বাংলাদেশ বাঁচবে।