নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসরকের একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে রপ্তানিকারক পণ্যেবাহী কাভাড ভ্যানে চুরি করে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন পণ্য রপ্তানিকারকরা।
কিছু ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায়। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশে পণ্য পৌঁছার পরে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীরা যখন কার্টন খোলেন, তখন চুরির বিষয়টি ধরা পড়ে। কারণ, কার্টন থেকে যারা পণ্য চুরি করে, তারাই আবার খালি অংশে বালু, মাটি কিংবা ঝুঁট কাপড় দিয়ে পূর্ণ করে সিল করে দেয়। আর এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে মৌচাক নিট কম্পোজিট কারখানা গত অক্টোবরে সাত হাজার পিস তৈরি পোশাক ইতালির এক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছে রপ্তানি করে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সেই প্রতিষ্ঠান ই-মেইলে জানায়, তারা তিন হাজার পিস পোশাক কম পেয়েছে। কার্টন ঠিক থাকলেও তার ভেতরে পোশাক কম ছিল। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো কার্টনে তৈরি পোশাক কম পাওয়া বর্তমানে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।
মৌচাক নিট কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, গত তিন বছরে চার-পাঁচবার আমাদের কারখানার পণ্য চুরি হয়েছে। ফলে গত মাসে ইতালির ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান যখন অভিযোগ করল, তখন অবাক হই নাই। ২৫-৩০ লাখ টাকার পণ্য খোয়া গেছে। এই পোশাক বর্তমানে তৈরি করে উড়োজাহাজে পাঠাতে হবে। এতে আমাদের খরচ হবে আরও ২০ লাখ টাকা।
নাসির উদ্দিন আরও বলেন, মহাসড়কে যে পণ্য চুরি হচ্ছে, তা নিজের গাঁটের টাকায় তৈরি করে উড়োজাহাজে পাঠাতে হয়। তাতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। তার চেয়েও বড় সমস্যা পণ্য চুরি হওয়ার ঘটনায় বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছে বিব্রতকর অবস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এটি বন্ধ করা না গেলে ক্রেতা হারানোর ঝুঁকি বাড়বে।
মহাসড়কে কতগুলো কাভার্ড ভ্যান থেকে রপ্তানিযোগ্য তৈরি পোশাক চুরি হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে দুটি চুরির ঘটনা ঘটে। পরের বছর সেটি বেড়ে ৯টিতে দাঁড়ায়। গত বছরের প্রথম সাত মাসেই এমন ২২টি ঘটনা ঘটে। আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত ২০-২৫টি ঘটনা ঘটেছে।
একাধিক পোশাকশিল্পমালিক জানান, অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানা ভাড়া করা কাভার্ড ভ্যানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কনটেইনার ডিপোতে পণ্য পাঠায়। কিছু কাভার্ড ভ্যানের চালকের সঙ্গে যোগসাজশে একটি চক্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা, ফেনী, মিরসরাই, সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় গাড়ি থামিয়ে হাতিয়ে নেয় তৈরি পোশাক। এই চক্রের সদস্যদের ধরতে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দাদের কাজে লাগাতে হবে বলে মনে করেন তারা।
দুই বছর আগে নারায়ণগঞ্জের আইএফএস টেক্সওয়্যারের পণ্য বোঝাই কাভার্ড ভ্যান চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোতে যাওয়ার পথে চুরির শিকার হয়। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির ৬০-৭০ হাজার ডলারের ক্ষতি হয়। পরে নতুন করে পণ্য তৈরি করে উড়োজাহাজে পাঠাতে হয়েছিল। যদিও পণ্য চুরির অভিযোগে দুটি কাভার্ড ভ্যান ডিপোতে আটকে রাখে মালিকপক্ষ।
আইএফএস টেক্সওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘটনার অনেক দিন পর অল্প কিছু পণ্য উদ্ধার হয়েছিল। তবে তা কোনো কাজে আসেনি। বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পাঠানোর সময় কাভার্ড ভ্যানে নিজেদের লোক দিই। তবে সব ক্ষেত্রে দেওয়া সম্ভব হয় না। তখন একধরনের উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয়।
মহাসড়কে চুরির ঘটনা বেড়ে গেলে গত বছরের জুলাইয়ে বিজিএমইএ নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যেভাবেই হোক, মহাসড়কে রপ্তানি পণ্য চুরি হওয়া বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স। চুরি ঠেকাতে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সিসিটিভি বসানোর কথাও বলা হয়।
সেই বৈঠকের পর ১৬ মাস পার হয়েছে। তবে মহাসড়কে রপ্তানি পণ্যের চুরি বন্ধ হয়নি। সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কাজও শেষ হয়নি। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার হাইওয়ে পুলিশের প্রধান মল্লিক ফখরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিজিএমইএ’র সভাপতি পণ্য চুরি বন্ধে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার ও দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে মহাসড়কে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর অনুরোধ করেন।
তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, প্রায়ই ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অভিযোগ আসছে, তারা পণ্য কম পাচ্ছে। চুরি বন্ধে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কথা থাকলেও তা হয়নি। একটা খসড়া এসওপি হলেও চূড়ান্ত হয়নি। সে জন্য আমরা গত কয়েক দিনে হাইওয়ে পুলিশ ও কাভার্ড ভ্যান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসেছিলাম। তারা প্রত্যেকে আন্তরিকভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।