নিউজ ডেক্স: অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি)’ আওতায় একজন ভাতাভোগীর ভাতা পাওয়ার কথা ছিল ২ হাজার ৮১৯ টাকা ৬০ পয়সা, তবে দশমিকের ভুলে ভাতাভোগীরা পেয়েছেন ২৮ হাজার ১৯৬ টাকা।প্রথম আলো
টাকার অঙ্কের ক্ষেত্রে একটি দশমিক কত গুরুত্বপূর্ণ, তার একটি বড় উদাহরণ তৈরি হয়েছে সরকারি একটি কর্মসূচির ভাতা বিতরণের ক্ষেত্রে। এক দশমিকের ভুলে নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে বাড়তি অর্থ চলে গেছে ভাতাভোগীদের হিসাবে। তাতে সরকারি কোষাগার থেকে বড় অঙ্কের অর্থ চলে গেছে। এ ঘটনা ঘটেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি কর্মসূচির আওতায় দেশের ৭ জেলার ১০ উপজেলায়।
জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি)’ আওতায় একজন ভাতাভোগীর ভাতা পাওয়ার কথা ছিল ২ হাজার ৮১৯ টাকা ৬০ পয়সা, তবে দশমিকের ভুলে ভাতাভোগীরা পেয়েছেন ২৮ হাজার ১৯৬ টাকা। এ ঘটনা ঘটেছে দেশের ১০ উপজেলার ৯ হাজার ৮৪৬ জন সরকারি ভাতাভোগীর ক্ষেত্রে।
তবে একেকজন ভাতাভোগীর ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যেসব উপজেলায় এ ঘটনা ঘটেছে সেগুলো হলো ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ সদর; বরিশাল সদর, পটুয়াখালীর বাউফল, খুলনার দিঘলিয়া, বাগেরহাটের মোংলা ও কচুয়া; মাগুরার মহম্মদপুর ও পিরোজপুর সদর। এসব উপজেলায় মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদের মাধ্যমে এসব ভাতা বিতরণ করা হয়।
ইজিপিপির আওতায় উল্লেখিত ১০ উপজেলার ৯ হাজার ৮৪৬ জন ভাতাভোগীর মধ্যে ৮ কোটি ৫৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা বিতরণের কথা থাকলেও দশমিকের ভুলে চলে গেছে ৮২ কোটি ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার ৪২৭ টাকা। এখন বিতরণ হওয়া বাড়তি টাকা উদ্ধারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) দায়িত্ব দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ইউএনও রামানন্দ পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের উপজেলার ৮৯০ জন ভাতাভোগীর হিসাবে ২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বেশি চলে এসেছিল। তার মধ্যে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি।’
ইজিপিপি কর্মসূচির আওতায় স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, মেরামত, সংস্কার, রাস্তা, ড্রেন, বাজার পরিষ্কারের মতো কার্যক্রম চালানো হয়। এ কাজে প্রতিদিনের ভাতার পরিমাণ ৪০০ টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ কর্মসূচির আওতায় একজন শ্রমিক ৭৬ দিন পর্যন্ত কাজের সুযোগ পান। সারা দেশের ৩৪৮টি উপজেলায় এই কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এসব উপজেলার মধ্যে নগদের মাধ্যমে ১৮ জেলার ১১৪টি উপজেলায় ইজিপিপির ভাতা বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ১০ উপজেলায় টাকার অঙ্কে গরমিলের ঘটনা ঘটে।
গত ২৫ জুন সকালে এসব উপজেলার ৯ হাজার ৮৪৬ জন ভাতাভোগীর হিসাবে টাকা পাঠানো হয়। ভাতাভোগীদের মধ্যে যাঁর পাওয়ার কথা ছিল ৩ হাজার ১৭২ টাকা ৫ পয়সা, তাঁকে পাঠানো হয় ৩ লাখ ১৭ হাজার ২০৫ টাকা। তবে ৩ লাখ টাকার বেশি নগদ হিসাবে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় সেই টাকার পুরোটাই ফেরত আসে। ফলে অনেক সুবিধাভোগী প্রাপ্য টাকাও পাননি।
আবার যাঁরা ৩ হাজার টাকার কম পাওয়ার কথা, তাঁদের হিসাবে বাড়তি টাকা চলে যায়। পরে অনেক সুবিধাভোগী নিজেরা স্থানীয় ইউএনও ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের বাড়তি টাকা পাওয়ার বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর ইউএনওরা যোগাযোগ করেন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের সঙ্গে। অধিদপ্তরের নির্দেশে ওই রাতেই নগদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট উপজেলার ভাতাভোগীদের টাকা উত্তোলন সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এর আগেই অনেকে টাকা তুলে নেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানিয়েছে, মোট ৯ হাজার ৮৪৬ জন ভাতাভোগীর কাছে বাড়তি টাকা গেলেও জানাজানির আগে টাকা তুলে নেন ৩ হাজার ১ জন। তাঁরা ৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার বেশি তুলে নেন।
জানা যায়, ভাতা বিতরণের জন্য সুবিধাভোগী ও টাকার অঙ্কের একটি তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে প্রথমে সরকারি বেতন-ভাতা বিতরণে ব্যবহৃত সফটওয়্যার আইবাস প্লাসে পাঠানো হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে তা রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকে যায়। সোনালী ব্যাংক তালিকা অনুযায়ী টাকা ছাড় করে বিতরণের জন্য তা নগদের বিতরণ ব্যবস্থায় পাঠিয়ে দেয়। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় একাধিক সফটওয়্যার বা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায়। ফলে বিতরণ পর্যায়ে এসে হিউম্যান এরর হওয়ার সুযোগ কম।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার ইউএনও এ কে এম লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের একটি ইউনিয়নে ১০ জনের হিসাবে ১ হাজার ৪০০ টাকার পরিবর্তে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা চলে এসেছিল। আমরা ৮ জনের কাছ থেকে বাড়তি টাকা ফেরত এনেছি। বাকি ২ জনের টাকাও ফেরত আনা সম্ভব হবে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইজিপিপির ভাতার টাকা বিতরণ করা হয় বিকাশ, রকেট ও নগদের মাধ্যমে। তবে গরমিলের ঘটনা ঘটেছে শুধু নগদের ক্ষেত্রে।
কিন্তু নগদ কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ‘ভাতাভোগী কোন ব্যক্তির কাছে কত টাকা যাবে, তা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরই ঠিক করে দিয়েছে। তাদের তালিকা ধরেই অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক হয়ে সোনালী ব্যাংকের সহযোগিতায় ভাতা বিতরণ হয়েছে। এরপরও কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য একটি সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। আমরা আশা করছি তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে দায় কার।’
এদিকে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে জানান, ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে কার দায়, তা বেরিয়ে আসবে। তবে ইতিমধ্যে ৮০ শতাংশ অর্থ উদ্ধার করা হয়েছে।