নিউজ ডেস্ক : ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট অনেকটাই বাস্তবমুখী ও সময়োচিত আখ্যায়িত করেছেন সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, সঙ্কুচিত এ বাজেট বাস্তবায়নে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে।
শুক্রবার (৭ জুন) সকালে উন্নয়ন সমন্বয়ের ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য সংসদে উপস্থাপিত বাজেট প্রতিক্রিয়ায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জিং এই সময়ে যথেষ্ট কৌশলের সাথেই এবারের বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। তাই একে আলাদাভাবেই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। একদিকে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা, অন্যদিকে বাংলাদেশের নিজস্ব সামষ্টিক অর্থনীতিও চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আতিউর রহমান বলেন, নতুন সরকারের এটি প্রথম বাজেট। সে বিচারে একেবারে শুরুতেই বলে নেয়া দরকার যে, এই প্রস্তাবিত বাজেটটি প্রাথমিকভাবে দেখে একে বাস্তবতার প্রতি অনেকটাই সংবেদনশীলই মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে এই বাজেটটিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরেকটু কল্যাণমুখী হওয়ার সুযোগ যে ছিল সে কথাও সত্য।
বিরাজমান বিনিয়োগ খরার মধ্যে ৬.৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন দূরুহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধিকে বলশালী করতে সরকারি ব্যয়েই মূলত ভরসা রাখতে হবে। বাড়তি ব্যয়ের চাপ না নিলে, বাজেট ঘাটতি আরও কম হতো। তাতে অন্তত দেশীয় ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমতো। জিডিপির শতাংশ হিসেবে বাজেট ঘাটতি ৪.৫ শতাংশ থাকায় এই ঘাটতির অর্ধেকের বেশি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে হবে।
জিডিপির শতাংশ হিসেবে ঘাটতি প্রতি ০.৫ শতাংশ করে কমানো গেলে ব্যাংকের সম্ভাব্য ঋণ প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা করে কমানো যেতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যটিও বেশ চ্যালেঞ্জিং উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, প্রায় দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি রয়ে গেছে। গত মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দশ শতাংশের বেশি এবং সার্বিক মূল্যস্ফীতিও প্রায় দশ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। এই বাস্তবতায় এই হার সাড়ে তিন শতাংশের মতো কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনা মোটেও সহজ হবে না। সেজন্য বাজেট ঘাটতি আরো কমিয়ে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের পরিমাণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই।
পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমানোর কথা কথা উল্লেখ করে আতিউর রহমান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব বোর্ডের ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে তার মাত্র ৩৭ শতাংশের মতো আসবে প্রত্যক্ষ কর থেকে। রাজস্ব বোর্ড তাদের লক্ষ্যমাত্রার ৬২ শতাংশের জন্যই নির্ভর করতে হবে পরোক্ষ করের ওপর। এক্ষেত্রে গতানুগতিকতা থেকে বেরুনো সম্ভব হয়নি।
শিক্ষা খাতের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে এ খাতের বরাদ্দের অনুপাত আরও বাড়ানো উচিৎ মন্তব্য করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্ণর বলেন, বরাবরের মতো মোট বাজেটের প্রায় ১২ শতাংশ যাচ্ছে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ে (খাতওয়ারি বরাদ্দের বিচারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দের ৬.৭ শতাংশ (খাতওয়ারি হিসেবে ৩য় সর্বোচ্চ) এ খাতে থাকলেও এর বড় অংশই অবকাঠামো উন্নয়নে যাচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়নের চাহিদা পূরণ করতে এ খাতে আরও বাড়তি বরাদ্দ একান্ত জরুরি।
স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের অনুপাত বাড়ানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের ৫.২ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দের অনুপাত বাড়ানো গেলে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির এই সময়ে জনগণ স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ থেকে কিছুটা সুরক্ষা পেত।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দে আরও উদার হওয়া যেতো। সামাজিক সুরক্ষায় বাজেটের ১৭.০৬ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে। চলতি বছরে ছিল ১৬.৫৮ শতাংশ। এর পুরোটাই বিপন্ন মানুষের জন্য নয়। সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন, সঞ্চয় পত্রের সুদ, বিভিন্ন বৃত্তির বরাদ্দও এখানে আছে।
তামাক-বিরোধী গবেষক ও নাগরিক সংগঠনের প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আসতো জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সিগারেটে কার্যকর করারোপের মাধ্যমে বাংলাদেশে ধূমপানের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনা এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির যে সুযোগ ছিল তা কাজে লাগানো হয়নি।
এসময় বাজেট নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা রেখে তিনি বলেন, বৈধ পথে সর্বোচ্চ ধাপের আয়ে ৩০ শতাংশ করারোপের বিপরীতে কালো টাকার ওপর তার অর্ধেক তথা ১৫ শতাংশ করারোপের প্রস্তাবটি গ্রহণীয় নয়। মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট বেশির ভাগ মানুষের আয় বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত না রেখে আরেকটু বাড়ানোর কথাও ভাবা যায়।
এছাড়াও তিনি আরও বলেন, মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর যে কর আরোপের কথা বলা হচ্ছে সেটও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে সোলার সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় ইনপুটস-এর ওপর আমদানি কর যতোটা সম্ভব কমানো ও সম্ভব হলে পুরোপুরি প্রত্যাহারের কথা ভাবা দরকার।