নিউজ ডেস্ক:
চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৮ শতাংশ ধরে বাজেট দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এখন দেশ চালানোর দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তী সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে।
সোমবার (২ ডিসেম্বর) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার-সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের কমিটির বৈঠকে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দীন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, বাণিজ্যসচিব মোহাং সেলিমউদ্দিনসহ আরও সচিব ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। বৈঠক শেষে জানতে চাইলেও অর্থ উপদেষ্টা বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির হারও সংশোধন করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, চলতি অর্থবছরের সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৯ শতাংশের নিচে রাখা হবে। গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বাজেট কাঁটছাট এবার অন্যবারের তুলনায় কম হবে। বৈঠকে উপস্থিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানোয় গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তাই বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাজেটে বড় ধরনের কাঁটছাট করার পরিকল্পনা থাকলেও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারে বকেয়া ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকায় সেটি করা যাচ্ছে না।
তারা আরও জানান, সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে বেশকিছু ক্ষতির পাশাপাশি বন্যাসহ নানান প্রকৃতিক দুর্যোগে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। তাই চলতি বাজেট সংশোধন করে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কমানো হচ্ছে। এবার মোট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয় ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ সরকার।
এদিকে আগের সরকারের আমলে ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার যে প্রবণতা ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসবে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার মনোযোগ দিচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণ নেওয়ার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচির শর্তের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণের মাত্রা কত হওয়া উচিত, তা উল্লেখ ছিল।
আইএমএফ বলেছিল, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ এখন যা আছে, তা ২০২৬ সালের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে ফেলতে হবে। এরপর থেকে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বরং নেতিবাচক হয়ে যায়। সরকারকে এখন বিক্রি বাড়ানোর কৌশল নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে।
বৈঠকে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করা হলে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব না আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব সংগ্রহ ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা কম। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বৈঠক থেকে ভ্যাট আদায়ের পাশাপাশি শুল্ক–কর ফাঁকি বন্ধ করে রাজস্ব বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়।
একই সঙ্গে কর-বহির্ভূত রাজস্ব বাড়ানোর বিষয়টিও আলোচনায় আসে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কিছু বৃদ্ধি ও বিনিময় হারে স্থিতিশীল থাকায় স্বস্তি রয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত দাতা সংস্থা থেকে কোনো বাজেট সহায়তা পাওয়া না গেলেও আগামী জুন নাগাদ আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্যান্য সংস্থা থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা আসবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বৈঠকে আগামী ২০২৫–২৬ সালের অর্থবছরের বাজেট নিয়েও আলোচনা হয়। এক্ষেত্রে ৮ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন বাজেট দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। তবে সেটি আগামী এপ্রিল মাসে সমন্বয় কাউন্সিলের কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। নতুন অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া মূল্যস্ফীতিও সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
মূল্যস্ফীতি কমার পক্ষে তাদের যুক্তি এরই মধ্যে সংকোচনশীল মুদ্রানীতির সঙ্গে বাজেটের ব্যয়ও সমন্বয় করা হয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের দাম কমে আসছে। একই সঙ্গে মুদ্রাবিনিময় হারের প্রভাবে আর মূল্যস্ফীতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে থাকলে আগামী জুন শেষে সেটি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৮ শতাংশ নেমে আসবে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।