যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতে চীনকে হটিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম

নিউজ ডেস্ক :
পোশাক শিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারে দিন দিন কমছে চীনের তৈরি পোশাকের আধিপত্য। গত দশ বছরে আন্তর্জাতিক পোশাক রফতানিতে চীনের অবস্থান প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অপরদিকে বাজার দখল করার দৌড়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। বিশেষ করে চীনের ছেড়ে যাওয়া বাজারের অনেকটাই দখল করে নিচ্ছে এই দুই দেশ।

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানির গত দশ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানিয়েছে পোশাক শিল্প সম্পর্কিত সংবাদমাধ্যম অ্যাপারেল রিসোর্স।

এদিকে কট্টর চীন বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কারণে সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পোশাক রফতানি আরও হ্রাস পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই শূন্যস্থান বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের পূরণের সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

অ্যাপারেল রিসোর্স তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে চলমান টানাপোড়েনের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রে দিন দিন কমছে চীনের পোশাক রফতানি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে বাড়ছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি।

যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড গার্মেন্টস বা ওটেক্সার তথ্য অনুযায়ী প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত দশ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে প্রায় ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ছিল ৪ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২২ সালে এই রফতানি উন্নীত হয় ৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে। অবশ্য ২০২৩ সালে আকস্মিকভাবে এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি প্রায় এক চতুর্থাংশ হ্রাস পেয়ে রফতানি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারে। যদিও এ সময় সামগ্রিকভাবেই কমে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক পণ্যের চাহিদা।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি হ্রাস পেয়েছিল ২২ দশমিক ০৪ শতাংশ, যার প্রভাবটাই মূলত পড়েছিল বাংলাদেশের পোশাক রফতানির ওপর।

দশকের পর দশক ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি করে আসছে চীন। তবে এই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করেছে গত এক দশকে। ২০১৪ সালে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রফতানি ছিল ২৯ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। সেখানে ২০২৩ সালে এই রফতানি হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এক দশকের মধ্যে রফতানি হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৪৫ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।

অ্যাপারেল রিসোর্সের প্রতিবেদনে এই রফতানি হ্রাসের কারণ হিসেবে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যিক টানাপোড়েনকেই দায়ী করা হয়েছে।

তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই বাণিজ্যিক সম্পর্কের অবনতির সুফল তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও ছাড়িয়ে গেছে ভিয়েতনাম। ২০১৪ সালেও যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি ছিল ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৩ সালে এই রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রফতানি বেড়েছে ৫২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রফতানি কমে যাওয়ার সুফল শুধু ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশই তোলেনি। ভারত, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোরও রফতানি বেড়েছে। গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ভারত ও পাকিস্তানের পোশাক রফতানি বেড়েছে যথাক্রমে ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশ ও ৩৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের পোশাক রফতানি ছিল ৩ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে এই রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে।

এদিকে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের পোশাক রফতানি ছিল ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার, পক্ষান্তরে ২০২৩ সালে এই রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলারে।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ার পোশাক রফতানি গত এক দশকে বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০১৪ সালে যেখানে দেশটির রফতানি ছিল ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৩ সালে এই রফতানি উন্নীত হয় ৩ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে।

গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পাশাপাশি হ্রাস পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস এবং ইন্দোনেশিয়ার পোশাক রফতানিও। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানি ১৩ দশমিক ৩১ শতাংশ, মেক্সিকোর ২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ, হন্ডুরাসের ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার রফতানি হ্রাস পেয়েছে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

অ্যাপারেল রিসোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বদলাতে থাকা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সবচেয়ে বেশি সুফল তৈরি পোশাক খাতে ঘরে তুলেছে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ।

ওটেক্সার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি বিষয় পরিষ্কার যে, পোশাকের ক্ষেত্রে দিন দিন চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা কমছে। ফলে চীনের বিকল্প হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক হিসেবে উঠে আসছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য হয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টর চীন বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের কারণে সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পোশাক রফতানির সুযোগ আরও সংকুচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রফতানি করা সব পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ হারে ট্যারিফ আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

সত্যিই যদি হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণের পর ট্রাম্প তার অঙ্গীকার মোতাবেক চীনা পণ্যের ওপর এই প্রতিশ্রুত ট্যারিফ আরোপ করেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পোশাক রফতানির সুযোগ আরও কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কপাল খুলতে পারে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর।

কারণ ওটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যেই গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পাশাপাশি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ। এ পরিস্থিতিতে মার্কিন পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে পণ্য না নিয়ে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের সরবরাহকারীদের ওপর আরও বেশি ঝুঁকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পাশাপাশি ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্কও সুবিধা করে দেবে ঢাকা ও হ্যানয়কে। কারণ যেখানে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছে, সেখানে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকা ও হ্যানয়ের সঙ্গে সম্পর্ক দিন দিন ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের উপস্থিতি ঠেকাতে একাট্টা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম। অপরদিকে জুলাই আগস্টের গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হওয়ার পর বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও ঘনিষ্ঠ হিসেবেই মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র।

সূত্র : সময়টিভি অনলাইন

পূর্ববর্তী নিবন্ধসশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বাড়ল আরও ২ মাস