নিউজ ডেস্ক : এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি বেড়েছে। গত বছর ঈদুল ফিতরে ২৪০টি দুর্ঘটনায় ২৮৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
এবার ৩৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৬৭ জন নিহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে নারী ৬৩ ও শিশু ৭৪ জন। এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় এবার দুর্ঘটনা বেড়েছে ৩৯ দশমিক ২০ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ২০ দশমিক ১৯ শতাংশ।
গত বছর ঈদযাত্রায় প্রতিদিন গড়ে ১৭ দশমিক ১৪টি দুর্ঘটনায় ২০ দশমিক ৩৫ জন নিহত হয়। এ বছর ঈদযাত্রায় প্রতিদিন গড়ে ২৩ দশমিক ৮৬টি দুর্ঘটনায় ২৪ দশমিক ৪৬ জন নিহত হয়েছেন।
এছাড়া ঈদ উদযাপনকালে সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচটি পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়া স্কুল, মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন ৭৪ জন৷
এবারের ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ১৫ দিনে (৪ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল) সারা দেশে এসব সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫শ’ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
এবার ঈদযাত্রায় ১৮৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৫৬ জন, যা মোট নিহতের ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৫১ দশমিক ১১ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৬৮ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৪১ জন, অর্থাৎ ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংগঠনটির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড.এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম এবং নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঈদযাত্রার এসময়ে তিনটি নৌ-দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত ও ৮ জন আহত হয়েছেন। ১৪টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়েছেন৷
যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্রদুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে বলা হয়, মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ১৫৬ জন (৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ), বাসের যাত্রী ১৮ জন (৪ দশমিক ৯০ শতাংশ), ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ড ভ্যান-ট্রাক্টর আরোহী ২৬ জন (৭ দশমিক ০৮ শতাংশ), প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাস-পাজেরো জিপ আরোহী ২৮ জন (৭ দশমিক ৬২ শতাংশ), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান) ৫৮ জন (১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-মাহিন্দ্র) ৯ জন (২ দশমিক ৪৫ শতাংশ) এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা আরোহী ৪ জন (১ দশমিক ০৮ শতাংশ) নিহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১২৯টি (৩৬ দশমিক ০৩ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৪৩টি (৩৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৪৮টি (১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে এবং ৩৮টি (১০ দশমিক ৬১ শতাংশ) শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনাগুলোর ৯৩টি (২৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৩৮টি (৩৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৭২টি (২০ দশমিক ১১ শতাংশ),পথচারীকে চাপা বা ধাক্কা দেওয়া ৪১টি (১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৪টি (৩ দশমিক ৯১ শতাংশ) অন্য বিভিন্ন কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ, ট্রাক্টর, ট্রলি, লরি, রেডিমিক্স গাড়ি ১৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-পাজেরো জিপ ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ, মোটরসাইকেল ৩২ দশমিক ৫৭ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-লেগুনা) ২০ দশমিক ৩৯ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-টমটম-মাহিন্দ্র-পাওয়ারটিলার) ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ, বাইসাইকেল-রিকশা ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ১ দশমিক ৮২ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৬৫৭টি। এরমধ্যে বাস ৮২, ট্রাক ৫৯, কাভার্ডভ্যান ১১, পিকআপ ২৮, ট্রলি ১০, লরি ৭, ট্রাক্টর ৬, রেডিমিক্স গাড়ি ১, মাইক্রোবাস ১৩, প্রাইভেটকার ২৪, অ্যাম্বুলেন্স ৩, পাজেরো জিপ ১, মোটরসাইকেল ২১৪, থ্রি-হুইলার ১৩৪ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-লেগুনা), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৩৫ (নসিমন-ভটভটি-টমটম-মাহিন্দ্র-পাওয়ারটিলার), বাইসাইকেল-রিকশা ১৭ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ১২টি।
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে ভোরে ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ, সকালে ২২ দশমিক ৯০ শতাংশ, দুপুরে ১৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ, বিকেলে ১৯ শতাংশ, সন্ধ্যায় ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং রাতে ২৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
মোট দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে ২৯ দশমিক ০৫ শতাংশ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ দুর্ঘটনায় ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ দুর্ঘটনায় ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনায় ৯ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ দুর্ঘটনায় ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ দুর্ঘটনায় ৬ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ৬ দশমিক ৭০ দুর্ঘটনায় ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ দুঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে ১০ দশমিক ০৮ শতাংশ৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী ঢাকায় ২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও ৫২ জন আহত হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১০৪টি দুর্ঘটনায় ১১৩ জন নিহত। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ২৩টি দুর্ঘটনায় ২২ জন নিহত। এছাড়া একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি ৩২টি দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও লালমনিরহাট জেলায়। এই ৪টি জেলায় স্বল্প মাত্রার কিছু দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানির সংবাদ পাওয়া যায়নি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে ঈদযাত্রা ও দুর্ঘটনা পর্যালোচনায় বলা হয়, এবারের ঈদুল ফিতরে রাজধানী থেকে কমবেশি ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঘরমুখী যাত্রা করেছেন এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৪ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছেন। ঈদের আগে ও পরে যথেষ্ট ছুটি থাকা, দেশের বিভিন্ন সড়কের অবস্থা ভালো থাকা, বৃষ্টি না হওয়া এবং সরকারের কিছুটা তৎপরতার কারণে ঈদযাত্রায় তেমন যানজট হয়নি, যাত্রা ছিল তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক।
এছাড়া ঈদযাত্রায় ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইন করায় টিকিট কালোবাজারি হয়েছে, ফলে মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। সড়ক ও নৌ-পথে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে। ঈদযাত্রায় সদরঘাটে ভেড়ানো লঞ্চের রশি ছিঁড়ে ৫ যাত্রী নিহত এবং কয়েকজনের আহতের ঘটনা সদরঘাটের নৈরাজ্য প্রমাণ করে।
প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ উল্লেখ করে বলা হয়, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির মতো ঘটনা।